ঢাকায় পৌঁছেছে সি আর দত্তের মরদেহ, শেষকৃত্য কাল
মুক্তিযুদ্ধের ৪ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব.) চিত্ত রঞ্জন দত্ত (সি আর দত্ত) বীর উত্তমের মরদেহ দেশে এসে পৌঁছেছে। আজ সোমবার সকাল ৮টা ৪০ মিনিটে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছে সি আর দত্তের মরদেহ। বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত সংবাদমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
গত ২৫ আগস্ট বাংলাদেশ সময় সকাল ৯টার দিকে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সি আর দত্ত মারা যান। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৩ বছর।
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনীন্দ্র কুমার নাথ স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এমিরেটস ০৫৮২ নম্বরের উড়োজাহাজে করে সোমবার সকাল ৮টা ৪০ মিনিটে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা থেকে সি আর দত্তের মরদেহ ঢাকায় এসে পৌঁছানোর কথা জানানো হয়। একই সঙ্গে কানাডা প্রবাসী মেজো মেয়ে চয়নিকা দত্ত ও তাঁর স্বামী রনি প্রান্টিস আসবেন। জেনারেল দত্তের যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বড় মেয়ে মহুয়া দত্ত, ছোট মেয়ে কবিতা দাশগুপ্ত ও একমাত্র ছেলে চিরঞ্জীব দত্ত একই দিন দিবাগত রাত ২টা ১০ মিনিটে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ঢাকায় এসে পৌঁছাবেন।
বিজ্ঞপ্তিতে আরো জানানো হয়, ঢাকা বিমানবন্দর থেকে জেনারেল দত্তের মরদেহ সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) হিমাগারে রাখা হবে। সেখান থেকে আগামীকাল মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৭টায় বনানীর ডিওএইচ ২ নম্বর সড়কের ৪৯ নম্বর বাড়ি হয়ে সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদন করতে ঢাকেশ্বরী মন্দির চত্বরে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে তাঁকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা দেওয়া হবে। মন্দির চত্বর থেকে আনুমানিক দুই ঘণ্টা পর সকাল ১১টায় মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে রাজারবাগ বরদেশ্বরী শ্মশানে। সেখানে শেষকৃত্যানুষ্ঠানের আগে জেনারেল দত্তের মরদেহের প্রতি সামরিক সম্মাননা জ্ঞাপনের জন্য গানস্যালুট প্রদান করা হবে।
করোনাভাইরাসজনিত পরিস্থিতির কারণে মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এবং হবিগঞ্জে তাঁর নিজ বাড়িতে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না বলেও বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
এদিকে সি আর দত্তের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে জাতীয় নাগরিক কমিটি গঠন করা হয়েছে। সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব.) কে এম শফিউল্লাহকে আহ্বায়ক ও বিশিষ্ট সাংবাদিক বুদ্ধিজীবী শাহরিয়ার কবীরকে সদস্য সচিব করে এক হাজার এক সদস্যবিশিষ্ট এই কমিটি গঠন করা হয়েছে।
ফ্লোরিডার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ২৪ আগস্ট রাতে মারা যান মুক্তিযুদ্ধের ৪ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ও বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) সি আর দত্ত। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৩ বছর।
১৯২৭ সালের ১ জানুয়ারি আসামের শিলংয়ে জন্ম নেন সি আর দত্ত। তাঁর পৈতৃক বাড়ি হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার মিরাশি গ্রামে। তাঁর বাবার নাম উপেন্দ্র চন্দ্র দত্ত ও মায়ের নাম লাবণ্য প্রভা দত্ত।
শিলংয়ের লাবান গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন সি আর দত্ত। পরে তাঁর বাবা চাকরি থেকে অবসর নিয়ে হবিগঞ্জে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। হবিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাই স্কুল থেকে ১৯৪৪ সালে তিনি মাধ্যমিক পাস করেন। পরে কলকাতার আশুতোষ কলেজে বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হয়ে ছাত্রাবাসে থাকা শুরু করেন তিনি। এরপর খুলনার দৌলতপুর কলেজের বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হন। পরে এই কলেজ থেকেই বিএসসি পাস করেন।
১৯৫১ সালে চিত্ত রঞ্জন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। কিছুদিন পর সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে কমিশন পান তিনি। ১৯৬৫ সালে সৈনিক জীবনে প্রথম যুদ্ধে লড়েন। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে পাকিস্তানের হয়ে আসালংয়ে একটি কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধ করেন। ওই যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য পাকিস্তান সরকার তাঁকে পুরস্কৃত করে।
বাংলাদেশ রাইফেলসের প্রথম ডিরেক্টর জেনারেল ছিলেন সি আর দত্ত। ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি হেডকোয়ার্টার চিফ অব লজিস্টিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৭ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন। ১৯৭৯ সালে বিআরটিসির চেয়ারম্যান হিসেবে কিছুদিন দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৮২ সালে তিনি পুনরায় মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। ১৯৮৪ সালে তিনি অবসর নেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সিলেট জেলার পূর্বাঞ্চল খোয়াই শায়েস্তাগঞ্জ রেললাইন বাদে পূর্ব ও উত্তর দিকে সিলেট ডাউকি সড়ক পর্যন্ত এলাকা নিয়ে গঠিত হয় ৪ নম্বর সেক্টর। এই সেক্টরে কমান্ডারের দায়িত্বে ছিলেন সি আর দত্ত।
দায়িত্ব নিয়েই প্রথমে সিলেটের রশিদপুরে ক্যাম্প তৈরি করেন সি আর দত্ত। বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে চা বাগান থাকার সুবাদে আড়াল থেকে শত্রুদের ঘায়েল করেন দ্রুত সময়ে। পরে তিনি রশিদপুর ছেড়ে মৌলভীবাজার ক্যাম্প স্থাপন করেন। তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য তাঁকে বীরউত্তম উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ঢাকার কাঁটাবন থেকে কারওয়ান বাজার সিগন্যাল পর্যন্ত সড়কটি ‘বীরউত্তম সি আর দত্ত’ সড়ক নামে নামকরণ করা হয়।