ঢাকা থেকে ২১ ঘণ্টায় পাটুরিয়া ফেরিঘাটে!

Looks like you've blocked notifications!
মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ফেরিঘাটে পারাপারের অপেক্ষায় থাকা যানবাহনের সারি। ছবি : এনটিভি

রাজধানীর শ্যামলীতে অবস্থিত ঢাকা-সাতক্ষীরা রুটের কে লাইন কাউন্টার থেকে আকাশ চৌধুরীর মুঠোফোনে কল করে জানিয়ে দেওয়া হয়, বিকেল ৫টার বাস আসতে ৬টা বাজবে। ততক্ষণে আকাশ কাউন্টারে পৌঁছে গেছেন। ৬টা ছাড়িয়ে রাত যখন ৮টা, তখনো বাসটি সাভারের জ্যামে আটকে ছিল। এরপর কাউন্টার থেকে জানানো হয়, বাস কখন এসে পৌঁছাবে বোঝা যাচ্ছে না। প্রচুর জ্যাম, রাত ১টাও বাজতে পারে। ঘটনা গতকাল বৃহস্পতিবারের।

রাত তখন সাড়ে ৮টা। আকাশ চৌধুরী সাভারের রফিকুল ইসলাম নামের এক ট্রাফিক সার্জেন্টকে ফোন করে রাস্তার অবস্থা সম্পর্কে জানতে চান। তখন রফিকুল বলেন, গাড়ি একটুও নড়ছে না। গত তিন ঘণ্টায় ৩০০ হাত রাস্তাও পার হতে পারেনি গাড়িগুলো। রাস্তার অবস্থা ভয়াবহ খারাপ।

রাত ৯টার সময় আকাশ সিদ্ধান্ত নেন, এভাবে আর কাউন্টারে বসে থাকা যাবে না। টিকেট বাতিল করতে হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনি টিকেট বাতিল করেন। টিকেট বাতিলের আগে আকাশের দুই বন্ধু তরিকুল ও ফয়সালের সঙ্গে শ্যামলীতেই দেখা হয় তাঁর। তাঁরা দুজন বিআরটিসির স্পেশাল এসি সার্ভিসে চার সিটের টিকেট কেটেছিলেন তিন হাজার টাকা দিয়ে।

টিকেট বাতিলের পর আকাশ সিদ্ধান্ত নেন দুই বন্ধুর পাশের সিটে বসে সাতক্ষীরা যাবেন। কিছুক্ষণ পর তানভীর শিপলু নামের আরেক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয় তরিকুল-ফয়সালদের। পরে আগের ওই দুই টিকেটের চার সিটে চারজন মিলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। সেই অনুযায়ী বিআরটিসি কর্তৃপক্ষের (সংগ্রাম পরিবহনের ম্যানেজার সিরাজ) সঙ্গে যোগাযোগ করেন আকাশ চৌধুরী। সংগ্রাম পরিবহন বিআরটিসির সঙ্গে মধ্যস্থতায় ব্যবসা করেন। মানে, বিআরটিসি বাসের যাত্রী খুঁজে দেয়। বিনিময়ে কাউন্টার ভাড়ার অর্ধেক পরিশোধ করে বিআরটিসির ইজারাদার কর্তৃপক্ষ। ইজারাদার কর্তৃপক্ষ হলো আলিফ এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড।

করোনাকালের নিয়ম অনুযায়ী শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে একজন ব্যক্তিকে দুই সিটের টিকেট কেটে যেতে হবে গ্রামে ঈদ করতে। কিন্তু আকাশ চৌধুরী সংগ্রামের ম্যানেজার সিরাজকে বলেন, ওই চার সিটে তাঁরা চারজন যেতে চান। যেতে হলে কী করতে হবে? সে সময় সিরাজ আকাশকে বলেন, আরো দুই হাজার টাকা দিতে হবে। এক হাজার টাকা বিআরটিসির সুপারভাইজার নেবে। বাকি এক হাজার টাকা আমি নেব। যদিও আগে কেনা ওই সিটের জন্য আরো দেড় হাজার টাকা পরিশোধ করে রাত ৯টার দিকে চার বন্ধু রওনা দেন গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার উদ্দেশে।

রাত তখন ১১টা। পেছনের দুই ঘণ্টায় শ্যামলী থেকে বাসটি টেকনিক্যাল মোড়ে গিয়ে পৌঁছায়। রাস্তায় প্রচুর যানজট। সেখান থেকে গাবতলী পার হয়ে সাভার যেতে সময় লাগে আরো চার ঘণ্টার বেশি।  সেখান থেকে মানিকগঞ্জ পর্যন্ত পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত তখন ৪টা। পাটুরিয়া ঘাট তখন ১৫ কিলোমিটার দূরে। পুরো রাস্তায় জ্যাম। গাড়ি চলতে শুরু করে থেমে থেমে। রাত ৪টা থেকে শুক্রবার বিকেল যখন ৬টা বাজে তখন পাটুরিয়ার ঘাটে এসে পৌঁছান ওই চার বন্ধু। মানে এই ১৫ কিলোমিটারের যানজট ঠেলে ফেরিতে উঠতে সময় লাগে ১০ ঘণ্টা।

কিন্তু ফেরিঘাটে এসে ওই চার বন্ধুর চোখে পড়ে কিছু অব্যবস্থাপনা। দেখা যায়, একটি ঘাট বরাদ্দ শুধু ভিআইপিদের ছোট ব্যক্তিগত  কারের জন্য। কিন্তু একটি ঘাট বরাদ্দ করা হলেও মূলত দুইটি ঘাট দিয়ে পারাপার হচ্ছিল ছোট গাড়িগুলো। অন্তত দুই ঘণ্টা ওই দুই ঘাট দিয়ে কোনো বাস যেতে দেখা যায়নি। এই যখন অবস্থা তখন আরেকজন ট্রাফিক সার্জেন্ট তাঁর ডিউটি শুরু করেন। তিনি এসেই ব্যক্তিগত গাড়ি যাওয়া বন্ধ করে দেন। এরপর বাসগুলো পার হতে শুরু করে। এভাবে সাড়ে ৬টার দিকে ফেরি পার হন আকাশ-তরিক-ফয়সাল ও শিপলু। চারজনই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন।

সাড়ে ৬টার সময় ফেরি পার হয়ে যখন সাতক্ষীরা জেলার ভেতরে ঢুকেন তখন সময় রাত সাড়ে ১০টা। ঢাকা থেকে সাতক্ষীরায় যেতে বাসে ভ্রমণ করার অভিজ্ঞতা, বিড়ম্বনা, রাস্তায় অব্যবস্থাপনা, যানজটের কারণে টিকেট পরিবর্তন করা এবং নিজেদের কাটা টিকেটে পুনরায় টাকা দিয়ে বসার গল্প সবই এই প্রতিবেদককে ওই চার বন্ধু জানান।

এদের ভেতর ফয়সাল ইসলাম সবুজ বলেন, ভিআইপিদের গাড়ি (ছোট কার) সব গেবরুই (চলে) যাচ্ছিল কিন্তু আমাদের গাড়ি যেতিলো (যাচ্ছিল) না। এত অব্যবস্থাপনা হলে সাধারণ মানুষ কোথায় যাবে?'

ওই চারজনের আরেকজন শিপলু বলেন, ১০ বছর ধরে ঢাকায় থাকি কিন্তু এমন অভিজ্ঞতা কখনো হয়নি। তবে শরীর ক্লান্ত লাগলেও খারাপ লাগছে না।

তরিকুল ইসলাম বলেন, একজন সার্জেন্ট পুরো ফেরিঘাট জিম্মি করে রেখেছিলেন। আরেকজন সার্জেন্ট এসে রাস্তা ক্লিয়ার করার চেষ্টা করেন। ওই সার্জেন্টের নামে মামলা করা উচিত। আর পরের সার্জেন্টকে সেলুট দেওয়া উচিত।

আকাশ চৌধুরী বলেন, প্রথমে বিকেল ৫টার বাস এলো না রাত ৯টার আগে। টিকেট পরিবর্তন করে বিআরটিসির এসি বাসে উঠলাম নিজেদের কেনা টিকেটের চার সিটে। কিন্তু আরো দুজন বেশি উঠায় আরো দেড় হাজার টাকা দিতে হয়েছে। যাই হোক, ঢাকার বাসা থেকে বের হওয়ার ২৫ ঘণ্টা পর ফেরিতে উঠেছিলাম। এ এক দারুণ অভিজ্ঞতা। তবে চার বন্ধু এক সঙ্গে থাকায় ভ্রমণটা আরামদায়ক হয়েছে।

বাসটিতে সুপারভাইজার ছিলেন শেখ ফরহাদ হোসেন। তিনিই আলিফ ইন্টারপ্রাইজ লিমিটেডের চারজন স্বত্বাধিকারীর একজন। তিনি বলেন, সংগ্রাম পরিবহনের সঙ্গে আমাদের চুক্তি আছে। সংগ্রাম আমাদের যাত্রী ম্যানেজ করে দেয়। বিনিময়ে আমরা ওদের শ্যামলী কাউন্টারের অর্ধেক ভাড়া দিয়ে দেই। শুধু শ্যামলী নয়, এমন কয়েকটি পরিবহনের সঙ্গে আমাদের চুক্তি আছে। বিআরটিসির কাউন্টারও আছে। বিআরটিসির মোট সাতটি বাস আমাদের ইজারা নেওয়া আছে। এই বাসটি ঢাকা থেকে সাতক্ষীরা পর্যন্ত যাবে আবার ঢাকায় ফিরবে। বিনিময়ে সরকারকে দিতে হবে ৪২ হাজার টাকা। ড্রাইভার ও তেল দুটোই সরকারি। আগামী মাসের ৩ তারিখ থেকে বিআরটিসির আরো দুইটি বাস চালাব আমরা। এটি ঈদের জন্য স্পেশাল সার্ভিস হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।