‘ধর্ষককে সুঠাম দেহের অধিকারী না ভেবে অপরাধী ভাবুন’
‘আমরা এখনো সেই সমাজে বাস করি, যে সমাজে মজনুকে প্রকৃত ধর্ষক হিসেবে বিবেচনা না করে চিন্তা করা হয় মজনু কেন সুঠাম দেহের অধিকারী হলো না। তার মানে আমাদের চিন্তা-চেতনা এমন, ধর্ষক ভিকটিমকে ডোমিনেট করবে অথবা সে সবল হবে। নিশ্চিতভাবেই এই চিন্তা পুরুষশাসিত সমাজ ব্যবস্থার বহিঃপ্রকাশ।’
নারী দিবস নিয়ে কথা বলার সময় গতকাল শনিবার এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) সহকারী পুলিশ সুপার শামীমা আক্তার সুমী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া মজনুকে নিয়ে সমাজের পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব এবং এই মনোভাবের শুরু কীভাবে, সেসব প্রসঙ্গে কথা বলেন শামীমা আক্তার সুমী। তিনি বলেন, ‘একজন ধর্ষককে নিয়ে এই যে মনোভাব, সেটা কিন্তু এমনি এমনি আসেনি। এটার সৃষ্টি হয়েছে একেবারে পরিবার থেকেই। শিশুকন্যাকে প্রাধান্য কম দেওয়া, বড় মাছের মাথাটা তার প্লেটে না দিয়ে ভাইয়ের প্লেটে দেওয়া, নারীকে নির্ভরশীল হতে শেখানোসহ নানা কারণে এই মনোভাবের উৎপত্তি। তবে এত বাধার পরও যে মায়েরা এগিয়ে যাচ্ছেন, তারা কিন্তু পরিবর্তনের চেষ্টা করছেন। এভাবে হয়তো একদিন আরো অনেক পরিবর্তন সম্ভব।’
‘আর এই পরিবর্তনের জন্য নারীদের এগিয়ে আসতে হবে। কারণ, একটি শিশুসন্তান জন্ম নেওয়ার পর কিন্তু মায়ের কাছেই বেশি সময় থাকে। সে ক্ষেত্রে ওই সন্তানের প্রতি মায়ের প্রভাবটা থাকে অনেক বেশি। সে জন্য নারীদের প্রতি পুরুষের মনোভাব বা নারীদের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে মায়েদের শিক্ষিত হওয়া ভীষণ জরুরি। মা শিক্ষিত হলে তিনিও চাইবেন, তার মেয়ে শিক্ষিত হোক। অন্যদিকে নারীদের প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনটা এই মায়ের কোল থেকেই হওয়া সম্ভব। কারণ, শিক্ষিত মা বর্তমান বাস্তবতা সম্পর্কে যা ভাবেন, তিনি তার সন্তানদের ভেতর তা ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করবেন। সুতরাং সমাজ পরিবর্তন করতে হলে নারীদের শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। হয়তো এখনো অনেক সময় লাগবে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে, তবে পরিবর্তন হবেই,’ যোগ করেন এই নারী পুলিশ কর্মকর্তা।
শামীমা আক্তার সুমী বলেন, ‘নারীদের প্রতি আমাদের যে চিরাচরিত মনোভাব, সেখান থেকে বের হয়ে আসতে হবে। নারীদেরও স্থান করে দিতে হবে। সহযোগিতা করতে হবে পুরুষদেরই। নারী দিবসে শুধু একদিন সম্মান না দেখিয়ে সব সময় এই বিষয়গুলো আমাদের মাথায় রাখা উচিত। নারীরা কিন্তু আজকাল সব পারে। হাজার হাজার নারী ভালো অবস্থানে আছেন, আরো যাচ্ছেন। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কিন্তু একজন নারী। অথচ তাঁর নেতৃত্বগুণে মুগ্ধ বিশ্ব। সুতরাং আমাদের চিরাচরিত মনোভাব পাল্টাতে হবে। একদিন আমরা অনেকদূর এগিয়ে যাব।’
শামীমা আক্তার সুমী বলেন, ‘এই যে একটি পরিবার থেকে আমরা উঠে আসছি। এর পেছনে কিন্তু আমার পরিবারের অনেক অবদান আছে। আমার বাবা-মা-ভাইয়েরা কিন্তু আমাকে পর্যাপ্ত সহযোগিতা করেছেন। তাঁরা আমাকে নারী হিসেবে না দেখে আমাকে মানুষ হিসেবে দেখেছেন। বিশেষ করে আমার বাবা কাজী আবুল হাশেম আমাকে এই স্থানে আসার জন্য সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন। তিনিও পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন। পেশা হিসেবে পুলিশিং অবশ্যই চ্যালেঞ্জিং। পুলিশের পোশাকে নিজেকে দেখা গৌরবেরও। কারণ, এখানে সরাসরি মানুষের জন্য কিছু করার অবারিত সুযোগ রয়েছে। আমি দেশের সেবা করতে চাই। সুতরাং প্রত্যেকের স্থান থেকে নারীদের মানুষ হিসেবে দেখতে হবে। এ ছাড়া নারীরাও এখনো পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব থেকে বের হতে পারেনি। তাঁরাও ভাবেন, আমার দ্বারা কি এটা সম্ভব? এটার জন্য অবশ্য আমাদের সমাজই দায়ী। তবে আমার মনে হয়, এই অবস্থা একদিন পরিবর্তন হবে।’
“নারীদের নির্ভরশীল হতে হবে, এই মনোভাব ঠিক না। নারীও একজন মানুষ। দেশের জন্য তারও অনেক কিছু করার আছে। সুযোগ তৈরি করতে হবে। নেপোলিয়ন বলেছিলেন, ‘আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের শিক্ষিত জাতি উপহার দেব।’ শুধু নারীদের অগ্রগতি নয়, পুরো জাতির উন্নতির জন্য নারীদের সামনে এগিয়ে আসতে হবে,” যোগ করেন সুমী।
শামীমা আক্তার সুমী বর্তমানে কর্মরত আছেন পুলিশের বিশেষ শাখার সদর দপ্তরে। মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা ও আটকে পড়া পাকিস্তানিদের নিয়ে কাজ করছেন তিনি।
সুমীর গ্রামের বাড়ি মাদারীপুর সদর উপজেলায়। তিনি রাজধানীর বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ রাইফেলস পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ২০০৪ সালে মাধ্যমিক ও ২০০৬ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে স্নাতক শেষ করেন। সর্বশেষ ২০১৪ সালে ৩৩তম বিসিএসের মাধ্যমে যোগ দেন পুলিশে। সুমীর স্বামী মো. জাহিদুল ইসলাম সোহাগও ৩৩তম পুলিশ ব্যাচের একজন কর্মকর্তা। এই দম্পতির রয়েছে সাইফান আবরীক জাহিন (৩) ও সাইহান আবরাজ তাহিন (সাত মাস) নামের দুই শিশুসন্তান।