নওগাঁয় পরীক্ষামূলক মালবেরি চাষে সাফল্য

Looks like you've blocked notifications!
নওগাঁর সাপাহার উপজেলায় বরেন্দ্র অ্যাগ্রো পার্কে নিজ বাগান থেকে মালবেরি ফল তুলছেন চাষি সোহেল রানা। ছবি : সংগৃহীত

দেশের সীমান্তবর্তী জেলা নওগাঁর সাপাহার উপজেলায় থোকায় থোকায় গাছে ঝুলছে মালবেরি (তুঁত জাতীয় ফল)। গাছজুড়েই শোভা পাচ্ছে সবুজ, লাল ও কালো লম্বাটে ছোট আকারের অসংখ্য মালবেরি বা তুঁত ফল। বিদেশি মূল্যবান ও অধিক পুষ্টিগুণ সম্পন্ন এই মালবেরি ফল এখন চাষ হচ্ছে দেশেই।

পরীক্ষামূলকভাবে বিভিন্ন দেশের আটটি জাত সংগ্রহ করে প্রথমবারেই সাফল্য পেয়েছেন সাপাহার উপজেলার বরেন্দ্র অ্যাগ্রো পার্কের উদ্যোক্তা সোহেল রানা। প্রথমবারেই ভালো ফলন দেখে বাণিজ্যিকভাবে এই ফল চাষের পরিকল্পনা করছেন তিনি।

বাণিজ্যিকভাবে চাষের পরিকল্পনার কথা জানিয়ে সোহেল রানা বলেন, ইতোমধ্যে চারটি জাত পছন্দ করেছি। চারা তৈরি করে এক বিঘা জমিতে ৪০০টি গাছ লাগিয়ে মালবেরি চাষ করব। আমার নতুন এই ফল দেখতে বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ আসছে। ইতোমধ্যে নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালকও এই গাছগুলো দেখে গেছেন। বাণিজ্যিক বাগান তৈরি করতে উৎসাহ দিয়েছেন তিনি।

সম্প্রতি সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, গাছে থোকায় থোকায় ঝুলে রয়েছে মালবেরি। পাতার চেয়ে ফল বেশি ধরে আছে। গাছের পাতা ডিম্বাকার, চমৎকার খাঁজযুক্ত এবং অগ্রভাগ সুচালো। আকারে আঙুরের চেয়ে কিছুটা বড় মালবেরি এই ফল। ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে ফুল আসে এবং মার্চ-এপ্রিলেই ফল পাকে। প্রথম অবস্থায় সবুজ পরে লাল এবং সম্পূর্ণ পাকলে কালো রং ধারণ করে। দেখতে খুবই সুন্দর, আকর্ষণীয়। পাকা ফল রসালো এবং টক-মিষ্টি। প্রতিটি গাছ থেকে ৮ থেকে ১০ কেজি ফল  সংগ্রহ করা যায়। এবং চারাও উৎপাদন করা যায় এবং খুব সহজেই ছাদে এই মালবেরি চাষ সম্ভব।

এ বিষয়ে কথা হয় উদ্যোক্তা সোহেল রানার সঙ্গে। তিনি জানান, বিদেশি দামি ও অধিক পুষ্টিগুণসম্পন্ন মালবেরি ফল। এই ফলটি বিদেশে বাণিজ্যিক ভাবে চাষ হয় এবং বাজারজাত করা হয়। বাজারেও এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। নতুন এই ফলটি আমি পরীক্ষামূলকভাবে থাইল্যান্ড, ভারত, তুরস্ক, অস্ট্রেলিয়া, ইতালিসহ কয়েকটি দেশ থেকে আটটি জাত সংগ্রহ করে এই মালবেরি চাষ করেছি। পরীক্ষামূলক চাষে প্রতিটা গাছে ফল আসায় সাফল্য এসেছে। এবং প্রচুর পরিমাণে ফল ধরেছে।

সোহেল রানা বলেন, এ ফল চাষে রোগবালাই খুবই কম। কীটনাশকও তেমন লাগে না। উৎপাদন খরচও কম। শুধু জৈব সার দিলে প্রায় সারা বছরই এই ফল পাওয়া যায়। যেহেতু এই মালবেরি আমদানি নির্ভর ফল, তাই বাজারে এই ফলের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। এই ফল ঢাকা শহরে সুপার শপগুলোতেও বিক্রি হয়।

সোহেল রানা আরও বলেন, এখন চিন্তা করছি চারা উৎপাদন করে বাণিজ্যিকভাবে এই মালবেরি ফল চাষের। ইতোমধ্যে চারটি জাত পছন্দ করেছি। চারা তৈরি করে এক বিঘা জমিতে ৪০০টি গাছ নিয়ে বাণিজ্যিক ভাবে এই মালবেরি চাষ করব। আমার নতুন এই ফল দেখে সবাই উদ্বুদ্ধ হয়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে এই ফল দেখতে আসছে।

সোহেল রানা জানান, ইতোমধ্যে নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. সামছুল ওয়াদুদ তার এই মালবেরি গাছগুলো পরিদর্শন করেছেন। তিনি তাকে উৎসাহিত করেছেন বাণিজ্যিকভাবে বাগান তৈরি করতে। তিনি যদি বাণিজ্যিকভাবে এই মালবেরি চাষ করতে পারেন তাহলে স্থানীয়ভাবে পুষ্টির জোগান দেওয়া যাবে। এমনকি স্থানীয় পুষ্টির চাহিদা মিটিয়ে সারা দেশে এর বাজারজাত করা যাবে।

সোহেল রানার বাগানে এই বিদেশি জাতের মালবেরি ফল দেখতে আসা শহীদুল ইসলাম বলেন, বরেন্দ্র অ্যাগ্রো পার্কে বিদেশি জাতের মালবেরি ফলের চাষ হচ্ছে তাই দেখতে এসেছি। ফলটি খেয়ে খুবই সুস্বাদু লাগল এবং দেখতেও অনেক সুন্দর। তার কাছ থেকে শুনলাম ছাদে নাকি এটা লাগানো যাবে। তাই আমিও সোহেল রানার কাছ থেকে চারা নিয়ে গিয়ে আমার বাড়ির ছাদে লাগাব।

নওগাঁর সাপাহার উপজেলায় বরেন্দ্র অ্যাগ্রো পার্কে গাছে শোভা পাচ্ছে থোকায় থোকায় মালবেরি। ছবি : সংগৃহীত

বরেন্দ্র অ্যাগ্রো পার্কে ঘুরতে আসা উম্মে সোহেলী সুলতানা বলেন, আমি বরেন্দ্র অ্যাগ্রো পার্কে ঘুরতে এসে দেখলাম বিদেশি এই মালবেরির গাছ লাগানো হয়েছে। গাছগুলোতে প্রচুর পরিমাণে ফল ধরেছে। দেখে খুবই ভালো লাগল। থোকায় থোকায় ফলটি দেখতে কত সুন্দর। একটা ফল খেয়ে দেখলাম, অনেক সুস্বাদু। আমি এখান থেকে চারা নিয়ে আমার বাড়ির ছাদে লাগাব।

স্থানীয় মোসাব্বের আহম্মেদ বলেন, সোহেল রানার বাগানে মালবেরি ফলের গাছটি দেখে আমি খুবই অবাক হয়েছি। থোকায় থোকায় এত বেশি পরিমাণে ফলটি ধরেছে। কোনোটা সবুজ, কোনোটা লাল, আবার কোনোটা কালো রং ধারণ করে আছে। এই ফলটি আমাদের এলাকায় আগে কখনও দেখিনি বা চাষাবাদ করা হয়নি। সোহেল রানার কাছ থেকে শুনলাম, বাজারে নাকি এর চাহিদা অনেক, দামও ভালো। তাই আমি মনে করি, কৃষকরা যদি মালবেরি ফলটি বাণিজ্যিকভাবে চাষ করে—তাহলে তারা ব্যাপকভাবে লাভবান হতে পারবেন।

জয়নাল নামে এক কৃষক বলেন, আমার বাড়ি জয়পুরহাটে। আমি সোহেল রানার এই বাগান দেখতে এসে মালবেরি ফল দেখলাম। গাছে থোকায় থোকায় খুব সুন্দর মালবেরি ধরে আছে। আমি কয়েকটি ফল খাইলাম, খুবই সুস্বাদু লাগল। ফলটি খেতে সুস্বাদু হওয়ায় এবং প্রচুর পরিমাণে হওয়ায় এখান থেকে আমি মালবেরির কয়েকটি চারা কিনলাম। লাগানোর পর ভালো ফল ধরলে, বেশি পরিমাণ জমিতে এই মালবেরি চাষ করব।

এ বিষয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিচালক কৃষিবিদ সামছুল ওয়াদুদ বলেন, সোহেল রানা একজন সফল চাষি। দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন ফল, ফুল, আমসহ নানা ধরনের বাগান আছে তার। সম্প্রতি তিনি আট জাতের মালবেরি চাষ করেছেন। বর্তমানে গাছ থেকে ফল তোলার উপযোগী হয়েছে। আটটি জাতের গাছ তিনি পরীক্ষামূলক লাগিয়েছেন। প্রতিটি গাছে প্রায় ৮ থেকে ১০ কেজির মতো ফল পাওয়া যাবে।

সামছুল ওয়াদুদ আরও বলেন, এখানকার মাটি মালবেরি চাষের উপযোগী। বাড়ির ছাদে টবেও এর চাষ করা যাবে। এই প্রথম সোহেল রানা বেশি সংখ্যক মালবেরির গাছ লাগিয়েছেন। নওগাঁতে মালবেরি চাষ যেন আগামীতে আরও বৃদ্ধি পায় সে জন্য আমরা চাষিদের নিয়ে প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেওয়ার পরিকল্পনা করছি।