নারায়ণগঞ্জ বোমা হামলা : ২১ বছরেও হয়নি বিচার, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের ক্ষোভ
আজ ১৬ জুন। নারায়ণগঞ্জ বোমা হামলা ট্র্যাজেডি দিবস। ২০০১ সালে আজকের দিনে নগরের চাষাঢ়ায় আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে বোমা হামলায় নেতাকর্মীসহ মোট ২০ জন নিহত হয়। আহত হন সংসদ সদস্য শামীম ওসমানসহ অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী।
বোমা হামলার ২১ বছর পেরিয়ে গেলেও এ হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি। মাত্র ৩৩ মাসে সাত খুন মামলার বিচার কাজ সম্পন্ন হলেও ২০ খুন মামলার বিচার না হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যেরা ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেন। ওয়ারেন্ট জারি হলেও কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তাসহ গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে না আসায় বিচারকাজে বিলম্ব হচ্ছে। প্রাণে বেঁচে যাওয়া আহতেরা পঙ্গুত্বের অভিশাপ নিয়ে বেঁচে আছেন।
২০০১ সালের ১৬ জুন। রাত তখন সোয়া ৮টা। সংসদ সদস্য শামীম ওসমান চাষাঢ়া শহীদ মিনারের পাশে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে যেই ভেতরের কক্ষে প্রবেশ করছেন, তখনই বিকট শব্দে বিস্ফোরণ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই টিনশেড অফিসঘরের চাল উড়ে গেছে। অনেকের শরীর থেকে হাত-পা বিচ্ছিন্ন হয়ে দেয়ালে এবং বিধ্বস্ত টিনের চালে ঝুলে থাকে। আহতেরা মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। পায়ের তলায় তখন রক্তের স্রোত বয়ে যায়। এ ঘটনায় চার নারীসহ ২০ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন সংসদ সদস্য শামীম ওসমানসহ অর্ধশতাধিক। তাঁদের মধ্যে অনেকেই এখন চিরতরে পঙ্গু। ঘটনার পরদিনই আওয়ামী লীগনেতা অ্যাডভোকেট খোকন সাহা বাদী হয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের আসামি করে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা দায়ের করেন। চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।
অন্যদিকে, বোমা হামলায় নিহত ফুটপাতের পিঠা বিক্রেতা হালিমা বেগমের ছেলে কালাম বাদী হয়ে শামীম ওসমান এবং তাঁর দুই ভাইসহ অনেককে আসামি করে মামলা করেন। পরে প্রথম মামলার বাদী খোকন সাহার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চআদালতের নির্দেশ মামলাটি খারিজ হয়ে যায়। এ মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন চারদলীয় জোট সরকারের উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু, ঢাকা সিটি করপোরেশনের তৎকালীন কমিশনার আরিফুল ইসলাম, নারায়ণগঞ্জ জেলা যুবদলনেতা শাহাদাতউল্লাহ জুয়েল, হরকাতুল জিহাদনেতা মুফতি হান্নানসহ ১০ জন।
দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২০০৩ সালে বিস্ফোরক মামলায় এবং ২০১৪ সালে হত্যা মামলায় তদন্তকারী সংস্থা পাঁচ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগ পত্র দখিল করে। কারাগারে রয়েছেন আদালতে একমাত্র স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়া শাহাদাতউল্লাহ জুয়েল। পলাতক রয়েছেন সহোদর আনিসুল মোরছালিন ও মাহাবুবুল মুত্তাকিম। জামিনে রয়েছেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শওকত হাসেম শকু। ১০১ জন সাক্ষীর মধ্যে বাদীসহ ১৭ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। মামলার সাক্ষী নিহতদের ময়নাতদন্তকারী কয়েক জন চিকিৎসক ও আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ডকারী ম্যাজিস্ট্রেট, তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ কয়েক জন সাক্ষী আদালতে হাজির না হওয়ায় তাঁদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। কয়েক জন সরকারি কর্মকর্তাসহ সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে না আসায় বিচারকাজে বিলম্ব হচ্ছে। আর এ পর্যন্ত যে কয়জন সাক্ষ্য দিয়েছেন, তাতেই বিচার হয় জানিয়ে মামলার বাদী আশা করেন।
২১ বছরের এখনও কেন এ মামলার বিচার হচ্ছে না—গণমাধ্যমকর্মীদের এমন প্রশ্নে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান বলেন, ‘এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো কোনো উত্তর আমার কাছে নেই। বুকভরা কষ্ট আছে, বেদনা আছে। তবে, সেইসঙ্গে আশাও রয়েছে এ কারণে যে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচারও কিন্তু দীর্ঘদিন আটকে ছিল। কিন্তু, সে বিচার হয়েছে এবং বিচারের রায়ও কার্যকর হয়েছে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি এবং আল্লাহর ওপর বিশ্বাস করি যে, এ ধরনের অপরাধ যারা সংঘটিত করেছে, অবশ্যই তাদের বিচার হবে এখানে।’
মামলার বাদী, নারায়ণগঞ্জমহানগর আওয়ামীলীগ, সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট খোকন সাহা বলেন, ‘মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ চলমান রয়েছে। বেশকিছু সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে। এবং যারা সাক্ষী, তাদের কাছ থেকে আমরা তেমন কোনো সাড়া পাচ্ছি না। আমরা যারা গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী, আমরা (সাক্ষ্য) দিয়েছি। এবার বিজ্ঞ আদালত যতটুকু সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে, তাতে প্রমাণ হয়েছে যে চাষাঢ়ায় আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে ভয়াবহ বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আমাদের লোকজনকে হত্যা করা হয়েছে, পঙ্গু বানানো হয়েছে। মূলত শামীম ওসমানকে হত্যা করার জন্যই এ হামলা সংঘটিত হয়েছিল।’
বোমা হামলার ঘটনা দায়ের করা দুটি মামলা এখন নারায়ণগঞ্জ অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ প্রথম আদালতে বিচারাধীন। একশ এক জন সাক্ষীর মধ্যে বাদীসহ ১৭ জনে স্বাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে বিচারকাজে বিলম্ব হয়েছে। এখন দ্রুত বিচারকাজ সম্পন্ন হবে মনে করেন নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট মনিরুজ্জামান বুলবুল।
তেত্রিশ মাসে সাত খুন মামলার বিচারকাজ সম্পন্ন হলেও ২০ খুন মামলার বিচার না হওয়ায় ক্ষুব্ধ ও হতাশ ক্ষতিগ্রস্ত ও ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যেরা।