নির্বাচন নিয়ে সারা দিনে সুপ্রিম কোর্টে যা ঘটল
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে। দুই দিনব্যাপী এই নির্বাচনের একদিন আগেই পদত্যাগ করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার অ্যাডভোকেট মনসুরুল হক চৌধুরী। আজ বুধবার (১৫ মার্চ) সকাল ১০টায় উভয়পক্ষের প্রার্থীরা উপস্থিত হন। এ সময় আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা ভোট শুরুর জন্য বলেন। তবে বিএনপিপন্থিরা নতুন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের দাবি জানায়। এ নিয়ে তর্কাতর্কি শুরু হলে আইনজীবীদের মধ্যে মারামারি, হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। কিন্তু নতুন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ ছাড়াই প্রথমদিন নির্বাচন হওয়া নিয়ে শুরু হয় মারামারি, উত্তেজনা, হট্টগোল।
এ সময় সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির বর্তমান সভাপতি ও আওয়ামীপন্থি প্যানেলের প্রার্থী অ্যাডভোকেট মমতাজ উদ্দিন ফকির পুলিশ ডেকে আনেন। পরে দুইপক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে হাতাহাতি উত্তেজনার সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে পুলিশের রোষানলে পড়েন কর্মরত সাংবাদিকরা। সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে পুলিশ সাংবাদিকদের ওপর লাঠিচার্জ করে। এ ঘটনায় প্রায় দশজন সাংবাদিক আহত হন। এ সময় পুরো সুপ্রিম কোর্টে আরও উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। কিছুক্ষণ ভোটগ্রহণ বন্ধ থাকে। তবে দুপুরের পর সাংবাদিক এবং বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা বের হয়ে গেলে ভোটগ্রহণ শুরু হয়। বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা প্রধান নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দিয়ে পুনরায় ভোটগ্রহণের দাবি জানায়। কিন্তু তাদের দাবি না মানায় এ ভোট বর্জন করে বিএনপিপন্থিরা।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির বিএনপিপন্থি প্যানেলে সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘গত বছর বিএনপির প্যানেল থেকে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমি নির্বাচন করেছি। আমি জয়লাভ করার পরও জোরপূর্বক ভোট চুরি করে ঘোষণা দেওয়া হয় মো. আবদুন নূর দুলালকে। আমরা ভেবেছিলাম তাঁরা গতবারের কলঙ্ক মুক্ত হয়ে এবার সুষ্ঠু নির্বাচন করবে। কিন্তু এবার সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনার জন্ম দিয়েছে। সুষ্ঠু ভোট না করতে দেওয়ার চাপে গতকাল প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদত্যাগ করেন। আমরা বলেছি, সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে নতুন করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিয়ে ভোট অনুষ্ঠিত হোক। কিন্তু বর্তমান সভাপতি মমতাজ উদ্দিন ফকির পুলিশ বাহিনীকে এনে সুপ্রিম কোর্টের বিএনপির আইনজীবী, সাংবাদিক সবার ওপরে লাঠিচার্জ করেছে।’
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি আওয়ামীপন্থী প্যানেলের প্রার্থী মোমতাজ উদ্দিন ফকির এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘সকালে আমরা শান্তিপূর্ণভাবে ভোটগ্রহণের জন্য চেষ্টা করি। কিন্তু বিএনপিপন্থিরা নির্বাচন বানচাল করার জন্য হট্টগোল শুরু করে। এক পর্যায়ে তারা উসকানি দিয়ে মারামারি শুরু করে। দুপুরের পর সুন্দরভাবে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়।’
যেভাবে ঘটনার শুরু
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনের ভোটকেন্দ্রে আজ বুধবার (১৫ মার্চ) সকাল ১০টা থেকে নির্বাচন শুরু হওয়ার কথা। ঘোষিত তফসিল অনুসারে, সমিতির দুই দিনব্যাপী এ ভোটগ্রহণ আজ ও আগামীকাল বৃহস্পতিবার হওয়ার কথা। আজ সকাল ১০টায় ভোটগ্রহণ শুরুর কথা ছিল। কিন্তু নির্বাচন পরিচালনা-সংক্রান্ত কমিটি নিয়ে সকাল থেকেই সমিতির মিলনায়তনের ভেতরে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তাপ ছড়ায়। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-সমর্থিত আইনজীবীদের মধ্যে কথা-কাটাকাটি হয়। ‘আগে চাই কমিশন, তারপরে নির্বাচন’ বলে এ সময় বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা মিলনায়তনের ভেতরে স্লোগান দেন।
সকাল পৌনে ১০টার দিকে মিলনায়তনে গিয়ে দেখা যায়, বিএনপি-সমর্থিত প্যানেল থেকে মনোনীত সম্পাদক প্রার্থী মো. রুহুল কুদ্দুস কাজলের সঙ্গে নির্বাচন পরিচালনা-সংক্রান্ত উপকমিটির একজন সদস্যের কথা-কাটাকাটি চলছে। তিনি ইসিকে বলেন, ভোটগ্রহণের পূর্বে বাক্সগুলো সবাইকে খুলে দেখান। গতকাল রাতে বাক্সগুলো ব্যালটপেপার দিয়ে ভরে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়ে তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। জবাবে ইসির ওই সদস্য বলেন, আমরা উপকমিটির পক্ষ থেকে প্রার্থীদের নির্ধারিত জায়গায় যেতে বলছি। নির্বাচন শুরু হবে। এ বক্তব্য সমর্থন করে আওয়ামী লীগ–সমর্থিত আইনজীবীরা ‘ইয়েস, ইয়েস’ বলে রব তোলেন।
এ সময় বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা বলেন, বাক্স খুলে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করুন। তারপর ভোট শুরু করেন। তারা এ স্লোগান দিতে থাকে। একপর্যায়ে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত এক আইনজীবীর সঙ্গে বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়।
এ সময় বিএনপি-সমর্থিত প্যানেল থেকে সভাপতি প্রার্থী ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ‘কমিশন বিষয়ে সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত নির্বাচন হবে না।’এ সময় বিএনপি-সমর্থিত আইনজীবীরা ‘ইয়েস, ইয়েস’ বলে রব তোলেন। এর পক্ষে-বিপক্ষে হইচই ও হট্টগোল শুরু হয়। বেশ কিছুক্ষণ তা চলে। বেলা পৌনে ১১টার দিকে মিলনায়তনে উপস্থিত একাধিক আইনজীবী জানান, ভোটগ্রহণ তখন পর্যন্ত শুরু হয়নি।
এ সময় আইনজীবী সমিতির সভাপতি পুলিশ ডাকেন। পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থানের প্রেক্ষাপটে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বেলা ১১টার ৪০ মিনিটের দিকে সমিতির মিলনায়তনে পুলিশ প্রবেশ করে। পুলিশ এসে সংবাদ সংগ্রহের জন্য থাকা সাংবাদিক ও আইনজীবীদের ওপর লাঠি চার্জ করে। পুলিশের লাঠিচার্জে বিএনপির প্রায় ১৫ জন আইনজীবী এবং ১০ জন সাংবাদিক আহত হন।
উত্তেজনার যেখান থেকে শুরু
গত সোমবার নির্বাচন পরিচালনা–সংক্রান্ত উপকমিটির আহ্বায়ক সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. মনসুরুল হক চৌধুরী ‘ব্যক্তিগত’ কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেন। এ প্রেক্ষাপটে ভোট হবে কি না কিংবা কে আহ্বায়ক হবেন, নাকি উপকমিটির অন্য সদস্যরা নির্বাচন পরিচালনা করবেন— এ নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার দিনভর আইনজীবীদের মধ্যে আলোচনা চলে।
গতকাল সন্ধ্যার পর সমিতি প্রাঙ্গণে আহ্বায়ক কমিটির প্রধান নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তাপ ছড়ায়। আওয়ামী লীগ-সমর্থিত আইনজীবীরা নির্বাচন পরিচালনা উপকমিটির আহ্বায়ক হিসেবে মো. মনিরুজ্জামানকে মনোনীত করেন। অন্যদিকে বিএনপি-সমর্থিত আইনজীবীরা এ এস এম মোকতার কবির খানকে আহ্বায়ক মনোনীত করেন।
প্রত্যক্ষদর্শী একাধিক আইনজীবীর ভাষ্য, গতকাল সন্ধ্যা সাতটার দিকে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত আইনজীবীরা মো. মনিরুজ্জামানকে আহ্বায়ক মনোনীত করার পর বিএনপি-সমর্থিত আইনজীবীরা মোকতার কবির খানকে আহ্বায়ক হিসেবে ঘোষণা দেন।
মনিরুজ্জামান নির্বাচনি কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ব্যালট পেপারে সই করতে সমিতির তিনতলার সম্মেলনকক্ষে যান। এতে আপত্তি জানান বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা। তাঁরা কিছু ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নেন। এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মিছিল, হইচই ও হট্টগোল হয়। একপর্যায়ে দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। উত্তপ্ত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে আজ সকাল থেকেই সমিতি ভবন ও প্রাঙ্গণে বিপুলসংখ্যক পুলিশ দেখা যায়।
সভাপতি একটি, সহসভাপতি দুটি, সম্পাদক একটি, কোষাধ্যক্ষ একটি, সহসম্পাদক দুটি, সদস্যের ৭টিসহ মোট ১৪টি পদে এক বছর মেয়াদের জন্য এ নির্বাচন হয়ে থাকে। সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির ১৪টি পদের মধ্যে বর্তমান সভাপতি, সম্পাদকসহ ৭টি পদে আছেন আওয়ামী লীগ–সমর্থিত আইনজীবীরা। সহসম্পাদক, কোষাধ্যক্ষসহ অন্য ৭টি পদে আছেন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা।
এবারের নির্বাচন পরিচালনার জন্য আগে সমিতির বর্তমান সম্পাদক মো. আবদুন নূর (আওয়ামী লীগ–সমর্থিত প্যানেল থেকে নির্বাচিত) আইনজীবী শাহ খসরুজ্জামানকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের উপকমিটি ঘোষণা করেছিলেন। অন্যদিকে কার্যনির্বাহী কমিটির সিনিয়র সহসম্পাদক মাহফুজ বিন ইউসুফ ও (বিএনপি–সমর্থিত প্যানেল থেকে নির্বাচিত) আইনজীবী এজেডএম ফরিদুজ্জামানকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের উপকমিটি ঘোষণা করেছিলেন। তবে ২ মার্চ উভয়পক্ষের সম্মতিতে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি এবারের (২০২৩-২০২৪) নির্বাচন পরিচালনার জন্য সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. মনসুরুল হক চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যবিশিষ্ট উপকমিটি পুনর্গঠন করা হয়েছিল। গত সোমবার মনসুরুল হক চৌধুরী পদত্যাগপত্র দেন।
সাংবাদিক আহতের প্রতিবাদ
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় পুলিশের হামলার শিকার হয়েছেন অন্তত ১০ জন সাংবাদিক। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে এটিএন নিউজের সাংবাদিক জাবেদ আক্তারের অবস্থা গুরুতর। তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
আহত অন্যরা হলেন—প্রথম আলোর ফটোসাংবাদিক শুভ্রকান্তি দাশ, জাগো নিউজের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ফজলুল হক, আজকের পত্রিকার নূর মোহাম্মদ, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের জান্নাতুল ফেরদৌস, বৈশাখী টেলিভিশনের ক্যামেরা পারসন ইব্রাহিম হোসেন, এটিএন বাংলার ক্যামেরাপারসন হুমায়ুন কবির, মানবজমিনের আবদুল্লাহ আল মারুফ।
পুলিশের হামলার শিকার সাংবাদিকরা জানান, দুপুর পৌনে ১২টার দিকে হট্টগোলের শব্দ শুনে তারা ভোটকেন্দ্রে যান। সেখানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা স্লোগান দিচ্ছিলেন। একপর্যায়ে পুলিশ আইনজীবীদের ওপর লাঠিচার্জ শুরু করেন। সেখানে সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে পুলিশ এক সাংবাদিককে লাথি মারেন। সকাল ১০টা থেকে ভোটগ্রহণের কথা ছিল। কিন্তু সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ভোটকেন্দ্রে ২০ থেকে ৩০ জন পুলিশ ঢুকে। তখন সাংবাদিকদের ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়।
ল রিপোর্টার্স ফোরামের সভাপতি আশুতোষ সরকার সাংবাদিকদের বলেন, ‘কর্তব্যরত সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনাটি আইনমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতিকে জানানো হয়েছে। তাঁরা লিখিত অভিযোগ চেয়েছেন। আমরা তাঁদের লিখিতভাবে বিষয়টি জানাব।’