নুসরাত হত্যা : খালাস চেয়ে অধ্যক্ষ সিরাজসহ ৪ খুনির আপিল
ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাসহ চার আসামির খালাস চেয়ে আপিল করেছেন। অপর তিনজন হলেন- নুরুদ্দিন, জাবেদ হোসাইন ও উম্মে সুলতানা পপি।
আজ সোমবার দুপুরের পর হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় চারজনের পক্ষে অ্যাডভোকেট জামিউল হক ফয়সাল আপিল দায়ের করেন।
আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় এ মামলায় গত ১৩ নভেম্বর ১৬ জন আসামির পক্ষে ‘জেল আপিল’ করে কারা কর্তৃপক্ষ। তবে আজ সোমবার চারজন আসামি ব্যক্তিগত আপিল করায় তাদের ‘জেল আপিল’ আর কার্যকর হবে না।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এম আমিন উদ্দিন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘কোনো আসামির পক্ষে জেল আপিল হওয়ার পর যদি নতুন কোনো যুক্তি দেখিয়ে আসামি আপিল করে তাহলে জেল আপিল অকার্যকর হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে শুধুত্র আসামির পক্ষের আপিলটি গ্রহণীয় হবে।’
জেল আপিল করলেন যারা
গত ১৩ নভেম্বর ফেনীর সোনাগাজীর চাঞ্চল্যকর নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৬ আসামির (আর্থিক) সামর্থ্য না থাকায় তাদের হয়ে বিধি অনুযায়ী কারা কর্তৃপক্ষ হাইকোর্টে আপিল করেছিল। তবে চারজন ব্যক্তিগতভাবে আপিল করায় তারা আর জেল আপিলের সুযোগ পাবেন না। অপর ১২ জন আসামি জেল আপিলের সুবিধা পাবেন।
হাইকোর্টের বিশেষ কর্মকর্তা সাইফুর রহমান এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘নুসরাত হত্যার দণ্ডপ্রাপ্ত ১৬ আসামি জেল-আপিল করেছিলেন। জেল আপিল হচ্ছে, আসামিদের নিজেদের আর্থিক সামর্থ্য না থাকলে তাঁরা জেল কর্তৃপক্ষের কাছে আপিলের জন্য আবেদন করেন। তখন জেল কর্তৃপক্ষ আসামিদের আইনি সুরক্ষায় আপিলের আবেদন হাইকোর্টে দায়ের করেন। সেইভাবে এই ১৬ আসামি আপিল করেছেন। ব্যক্তিগত আপিল করায় এখন জেল আপিলকারীর সংখ্যা কমে এসেছে।
মামলার আসামিরা হলেন
এ মামলায় মোট আসামির সংখ্যা ১৬ জন। যাদের প্রত্যেকের ফাঁসির আদেশ হয়েছে। তাঁরা হলেন- প্রধান আসামি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এস এম সিরাজ-উদ-দৌলা, দুই নম্বর আসামি ফেনী কলেজের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ও অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা মুক্তি পরিষদ আন্দোলনের আহ্বায়ক মো. নুর উদ্দিন, তিন নম্বর আসামি মাদ্রাসার ফাজিলের ছাত্র শাহাদাত হোসেন শামীম, চার নম্বর আসামি পৌর আওয়ামী লীগের সদ্য বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক এবং ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মাকসুদ আলম, পাঁচ নম্বর আসামি ছাত্রলীগকর্মী ও মাদ্রাসার ফাজিল বিভাগের ছাত্র মো. জোবায়ের, ছয় নম্বর আসামি চরচান্দিয়া ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সভাপতি ও মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী জাবেদ হোসেন, সাত নম্বর মাদ্রাসার হেফজ বিভাগের শিক্ষক এবং ফাজিল দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র হাফেজ আবদুল কাদের, আট নম্বর আসামি মাদ্রাসার ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক আফছার উদ্দিন।
অন্য সাজাপ্রাপ্তরা হলেন- মাদ্রাসার ফাজিল প্রথম বর্ষ ও ফেনী পলিটেকনিক কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র আবদুর রহিম ওরফে শরীফ, অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা মুক্তি পরিষদ আন্দোলনের সদস্য ও ছাত্রলীগকর্মী মো. শামীম, অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা মুক্তি পরিষদ আন্দোলন সদস্য ও ফেনী কলেজের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র এমরান হোসেন মামুন, মাদ্রাসা শাখা ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ইফতেখার উদ্দিন রানা, অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা মুক্তি পরিষদ আন্দোলনের সদস্য ও ছাত্রদলকর্মী হিসেবে পরিচিত মহিউদ্দিন শাকিল, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. রুহুল আমিন, মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী উম্মে সুলতানা পপি, মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী কামরুন নাহার মণি।
এর আগে গত ২৪ অক্টোবর ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার দায়ে মামলার প্রধান আসামি অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাসহ ১৬ খুনির সবার ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত।
ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ সব আসামির উপস্থিতিতে এ রায় দেন।
নুসরাত হত্যার নেপথ্যে
মামলার বিবরণে জানা যায়, ফেনী সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার আলীম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে চলতি বছরের ২৬ মার্চ ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা তাঁর অফিসকক্ষে ডেকে নিয়ে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেন। এ ঘটনায় নুসরাতের মা শিরিন আক্তার বাদী হয়ে গত ২৭ মার্চ সোনাগাজী থানায় অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাকে আসামি করে একটি মামলা করেন। এ মামলায় গত ২৭ মার্চ পুলিশ অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাকে গ্রেপ্তার করে।
সিরাজ-উদ-দৌলার নির্দেশে মাকসুদ কমিশনার, শাহাদাত হোসেন শামীম তাঁদের অনুসারীদের নিয়ে অধ্যক্ষের মুক্তির দাবিতে সোনাগাজী বাজারে মানববন্ধন করে এবং থানা ঘেরাও করার চেষ্টা করে। একই সঙ্গে সিরাজ-উদ-দৌলার অনুসারীরা নুসরাতকে মামলাটি উঠিয়ে নেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে। কিন্তু নুসরাত মামলা উঠিয়ে নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
পরে গত ৬ এপ্রিল সকালে নুসরাত আলিমের আরবি প্রথম পত্র পরীক্ষা দিতে মাদ্রাসায় গেলে দুর্বৃত্তরা তাকে ডেকে কৌশলে মাদ্রাসার ছাদে নিয়ে যায়। পরে তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। দগ্ধ নুসরাত ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পাঁচ দিন পর ১০ এপ্রিল রাতে মারা যান।
পরের দিন ১১ এপ্রিল বিকেলে সোনাগাজীতে জানাজা শেষে নুসরাতকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। এ ঘটনায় নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বাদী হয়ে ৮ এপ্রিল নুসরাতকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন। পরে সেটি হত্যা মামলায় রূপান্তর করা হয়।
নুসরাতের ওপর হামলার ঘটনায় ফেনী, সোনাগাজীসহ সারা দেশের মানুষ ফুঁসে ওঠে। মশাল মিছিল, মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল করে দোষীদের গ্রেপ্তার ও বিচার দাবি করে।
তবে নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার জন্য স্থানীয় প্রভাবশালী গোষ্ঠী, থানা পুলিশ, কয়েকজন সুবিধাভোগী সাংবাদিক মরিয়া হয়ে অপপ্রচার চালাতে থাকে। সে সময়ের জেলা পুলিশ সুপার এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার সোনাগাজী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেনের পক্ষে সাফাই গেয়ে নুসরাত আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন বলে পুলিশ সদর দপ্তরে প্রতিবেদন দেয়।
এ প্রতিবেদনের কারণে পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম সরকারকে ফেনী থেকে প্রত্যাহার করে ঢাকা পুলিশ সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়। একই সময়ে সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে প্রত্যাহার করা হয়। এর আগে গত ২৭ মে নুসরাতের শ্লীলতাহানির ঘটনায় ওসি মোয়াজ্জেম নুসরাতকে থানায় জিজ্ঞাসাবাদের নামে হেনস্তা করার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। ভিডিও প্রচারের এ ঘটনায় আইসিটি আইনে মামলায় ওসি মোয়াজ্জেমের এরই মধ্যে আট বছরের কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানা করেন ট্রাইব্যুনাল। তিনি বর্তমানে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছেন।
পরে এ মামলা তদন্ত করার জন্য পিবিআইর কাছে হস্তান্তর করা হয়। তদন্ত শেষে গত ২৯ মে ফেনীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জাকির হোসেনের আদালতে ১৬ জনকে অভিযুক্ত করে ৮০৮ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র দেন নুসরাত হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পরিদর্শক মো. শাহ আলম।
এ মামলায় আটক থাকা চার্জশিটের বাইরের পাঁচজনকে বিচারিক আদালত মামলার দায় থেকে অব্যহতি দেন। তাঁরা হলেন কেফায়েত উল্লা, আরিফুল ইসলাম, নূর হোসেন, সাইদুল ইসলাম ও আলাউদ্দিন।
অভিযোগপত্রভুক্ত ১৬ আসামির মধ্যে ১২ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। ৩০ মে মামলাটি ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়। ১০ জুন আদালত মামলাটি আমলে নিলে শুনানি শুরু হয়। ২০ জুন অভিযুক্ত ১৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন বিচারিক আদালত। এর পর ২৭ ও ৩০ জুন মামলার বাদী ও নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমানকে জেরার মধ্য দিয়ে এ মামলার বিচারকাজ শুরু হয়। এরপর মোট ৯২ সাক্ষীর মধ্যে ৮৭ জনের সাক্ষ্য নেন আদালত।