নৌকায় জন্ম ওদের, নৌকায় বেড়ে ওঠা
জন্মের সময় কিংবা জন্মের পরেও ওরা পায় না একটু চিকিৎসাসেবা। সেই সনাতনী প্রক্রিয়ায় একজন বৃদ্ধা দাইয়ের হাতে ওদের জন্ম। জন্মের পরে নদীর তীরের দোকান থেকে কেনা একটি ব্লেড দিয়ে ওদের নাড়ি কাঁটা হয়। জন্মক্ষণে মায়ের গর্ভ থেকে বয়ে আনা রক্তকণা ধুয়ে দেওয়া হয় নদীর পানি দিয়ে। নৌকার উনুনে নদীর পানি গরম করে জীবনের প্রথম গোসল করানো হয় এসব শিশুকে। জন্ম থেকেই ওদের জীবন কাটে নদীর জলে। কারণ, ওদের জন্ম নৌকায়। ওরা ‘মান্তা শিশু’।
মান্তা পরিবারের শিশুরা প্রথম হাঁটতে শেখে নৌকায়। একটু হাঁটা শিখে গেলেই নৌকা থেকে পানিতে পড়ে যাওয়ার ভয় থাকে। তখন এসব শিশুর হাতে, কোমরে, পায়ে বেঁধে দেওয়া হয় ঝুনঝুনি (এক প্রকার শব্দ সৃষ্টিকারী ঘণ্টা)। তবু নিয়তি ওদের পানির দিকে ডেকে নিয়ে যায়। বহরের অনেক শিশুই নদীতে হারিয়ে যায় চিরতরে। নদীর বুকেই ওদের জন্ম, সেই নদীর বুকেই মৃত্যু। তাই ওদের সঙ্গে নদীর সম্পর্ক জন্ম-জন্মান্তরের।
ভাসমান নৌকায় যুগ যুগ ধরে বসত করা জনগোষ্ঠীর নাম ‘মান্তা’। এ যেন প্রতিনিয়ত ঠিকানাবিহীন গন্তব্যে ভেসে চলা। নির্দিষ্ট বাসস্থান, শিশু শিক্ষা, চিকিৎসাসহ মৌলিক অধিকারের খোঁজ মেলে না তাদের জীবনে। দেশের নাগরিক হয়েও মৌলিক অধিকারহীন জীবন কাটাচ্ছে মান্তা পরিবার ও তাদের শিশুরা।
মান্তাদের প্রধান পেশা মাছ ধরা। মাছ শিকারের স্বল্প রোজগারে নৌকার ছাউনিতে ওদের চুলা জ্বলে। তাই শিশুরাও অল্প বয়সে শিখে যায়, মাছ ধরার নানা কৌশল।
একাধিক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে মান্তা পরিবারের সংখ্যা প্রায় দুই হাজার। এসব পরিবারে কম করে হলেও প্রায় তিন হাজার শিশু রয়েছে। বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার উলানিয়া মেঘনাপাড়, লাহারহাট ও মিরগঞ্জ, হিজলা উপজেলার হরিনাথপুর, ভোলার ইলিশা ফেরিঘাট, পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার চরমোন্তাজসহ একাধিক জায়গায় দেখা মেলে মান্তা সম্প্রদায়ের। তাদের বহরের প্রত্যেকটি নৌকায় দেখা যায় একাধিক শিশু। সেসব শিশুর জীবনযাত্রা দেখে খুব সহজেই অনুভব করা যায়, কতটা অন্ধকারে রয়ে যাচ্ছে মান্তা শিশুরা।
মান্তা পরিবারে বেড়ে ওঠা শিশুদের জন্ম নিবন্ধন নেই। জন্মের পরে ওরা টিকাও নেয় না। আর শিক্ষা যেন এক অমাবস্যার চাঁদ। প্রাথমিক শিক্ষার গণ্ডি ছাড়াতে পারে না মান্তা পরিবারের অধিকাংশ শিশু।
জন্মের পরেই শুরু হয় ওদের বাঁচার লড়াই। শিশুদের চেহারার দিকে তাকালেই সহজে আন্দাজ করা যাবে, কতটা অপুষ্টির শিকার প্রতিটি শিশু।
নৌকায় বেড়ে ওঠা একটি শিশুর বন্ধুত্ব হয় আরেক নৌকার শিশুদের সঙ্গে। পরিবার নিয়ে ভাসমান বহর যখন কোথাও নৌকা বাঁধে, তখন শিশুরা নৌকার বাইরে একখণ্ড মাটির দুনিয়ার স্পর্শ পায়। খোলা মাঠ পেলে ওরা মেতে ওঠে নানা প্রকার খেলাধুলায়। ডাংগুলি, মার্বেল, লাটিম, কানামাছি, বৌচি ইত্যাদি নানা খেলায় মুখর হয় ওদের ভুবন।
এমন একটি মান্তা পরিবারে জন্ম আরিফ (১৪)। বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উলানিয়া মেঘনা পাড়ে একটি মান্তা নৌকায় দেখা হয় তার সঙ্গে। আরিফ জানায়, ছোট বেলা থেকেই তার লেখাপড়ার সুযোগ আসেনি। মা-বাবাও কখনো বলেনি লেখাপড়ার বিষয়ে।
আরিফের মতে, ‘লেখাপড়ার কথা বলবেই বা কী করে? খরা মৌসুমে থাকি এক স্থানে, বর্ষার সময় অন্য জায়গায়। যখন নতুন ধান কাটার সময় হয়, তখন আমরা অন্যের ক্ষেতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করি। যে অঞ্চলে কাজ করি, তার আশেপাশেই নৌকা বাঁধি। এমন করে কি লেখাপড়ার সুযোগ হয়?’
পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার চরমোন্তাজ সুলিজ খালের ভেতরে অবস্থান নিয়েছে একটি মান্তা বহর। এখানে রয়েছে ৩০টি মান্তা পরিবার। এর মধ্যে একটি পরিবারের কর্তা জাহাঙ্গীর (৫০)। তিনি বলেন, ‘আমরা ছোট বেলা থেকে নৌকায় বড় হয়েছি। আমাদের বাচ্চারাও এতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। আমাদের পরিবারের বাচ্চাগুলো শিক্ষা, স্বাস্থ্য, থাকা, খাওয়াসহ নানা দিক দিয়ে পাড়ের (স্থলে বসবাসরত) শিশুদের থেইক্যা (থেকে) পাউছানো (পেছানো)। কিন্তু আমরা নিরুপায়, কিছুই করনের (করার) নাই।’
মান্তা শিশুদের জীবনব্যবস্থা নিয়ে কথা হলে চরমোন্তাজের শিক্ষক ও উন্নয়নকর্মী আইয়ুব হোসেন জানান, সম্প্রতি একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা চরমোন্তাজের মান্তা শিশুদের পড়ালেখার জন্য এ অঞ্চলে একটি স্কুল বোট (ভাসমান স্কুল) প্রতিষ্ঠা করেছে। তবে সমগ্র মান্তা শিশুর শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে তা পর্যাপ্ত নয়। মান্তা শিশুদের জীবন উন্নয়নে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ও স্থায়ী বসবাসের সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে ভবিষ্যতে এই সম্প্রদায়ের জলেভাসা জীবনের অবসান হবে।’
এ বিষয়ে কথা হলে বরিশাল ব্রজমোহন কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও গবেষক ড. মু. ইব্রাহীম খলিল বলেন, ‘আমাদের দেশে নিজ ভূখণ্ডের ভেতরেই কিছু সম্প্রদায় পিছিয়ে রয়েছে। এরা স্বাভাবিকের থেকেও অধিকারহীন হয়ে বেঁচে আছে। সবার মতো এরা সুযোগ-সুবিধা পায় না। মান্তারা তেমনি একটি সম্প্রদায়।’
ইব্রাহীম খলিল আরো বলেন, ‘সমাজতাত্ত্বিক গবেষণাগুলোতে দেখা যায়, মান্তারা প্রকৃত দরিদ্র ও অভাবী। শিশুদের সুশিক্ষিত করার সুযোগ কিংবা পরিবেশ এসব পরিবারের নেই। মান্তা শিশুদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে দীর্ঘমেয়াদি কিছু পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। মান্তা পরিবারগুলোকে অভাবমুক্ত করা গেলে তারা উন্নত জীবনের দিকে ধাবিত হবে। সরকারি খাসজমি মান্তাদের বরাদ্দ দেওয়া হলে তারা স্থায়ী ঘর-বাড়ি নির্মাণ করবে। ফলে তাদের জীবনযাত্রায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও প্রযুক্তি চাহিদা বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি শিশুদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্পর্কে মান্তা পরিবারগুলোকে সচেতন করে তুলতে পারলে আগামীতে নির্মূল হবে মান্তা শিশুদের এমন অমানবিক ভাসমান জীবনযাত্রা।’