পাপিয়া-যোগ : মানবজমিনের সম্পাদকের বিরুদ্ধে সাংসদের মামলা
নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক শামীমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউয়ের সঙ্গে সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের যোগাযোগের তথ্য উল্লেখ করে সংবাদ প্রকাশ এবং এ কারণে মানহানীর অভিযোগ এনে দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে।
মাগুরা-১ আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান শিখর গতকাল সোমবার রাতে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এজাহার দায়ের করেন। তিনি বলেছেন, ওই সংবাদ প্রকাশ করে তাঁকে ‘হেয়-প্রতিপন্ন করে স্বার্থ হাসিলের অপচেষ্টা’ করা হয়েছে।
মামলায় সম্পাদক ছাড়াও পত্রিকাটির প্রতিবেদক এবং প্রতিবেদনটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়ানোর অভিযোগ এনে আরো ৩১ জনকে আসামি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন শেরেবাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জানে আলম মুন্সী।
আজ মঙ্গলবার রাতে ওসি এনটিভি অনলাইনকে, ‘কাল সোমবার রাতে মামলাটির এজাহার আমাদের হাতে আসে। তবে আজ মঙ্গলবার মামলাটি আনুষ্ঠানিকভাবে ফাইল করা হয়েছে। মামলায় মোট আসামি ৩২ জন। পরে আজই মামলাটির কাগজপত্র আদালতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।’
মামলাটি তদন্তের পর্যায়ে আছে। তদন্তকালে যদি কাউকে গ্রেপ্তার করার প্রয়োজন হয় তাহলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান ওসি জানে আলম মুন্সী।
আজ সকালে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এ মামলার এজাহার ও প্রাথমিক তথ্য বিবরণী (এফআইআর) আসে। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সারাফুজ্জামান আনসারী মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আগামী ২০ এপ্রিল দিন ধার্য করেন বলে জানিয়েছেন আদালতের সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা (জিআরও)।
মতিউর রহমান চৌধুরী ছাড়া মামলার অন্য আসামিরা হলেন মানবজীবন পত্রিকার নিজস্ব প্রতিবেদক আল-আমিন, ফেসবুক ব্যবহারকারী (আইডির নাম) শফিকুল ইসলাম কাজল, প্রিন্স ফাহিম, আরিফুল ইসলাম আরিফ, ফরহাদ খান, জুয়েল আহমেদ, মোহাম্মাদ মোসলেম, মিজানুর রহমান, মোর্শেদ আলম, কাঁকন আবু হানিফ, মো. রুবেল, আয়েশা আমান, মো. শামিম আক্তার, মো. সাত্তার মৃধা, মো. তৌফিক, মিলি হাসান, হাবিব আদনান, ঋষি কান্ত, মো. সোহেল হোসেন, ছালেহ আহমেদ, জসিম উদ্দিন জসিম, খাইরুল ইসলাম, হেদায়েতুল ইসলাম, মাহফুজ আহমেদ, এম এ মামুন, মো. হেলাল, সেলিম চৌধুরী, ইস্পাত মোহাম্মাদ, বেলায়েত হোসেন, মারুফ রাজু ও মকটেল হোসেন মুক্তি।
গত ২২ ফেব্রুয়ারি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে নয়াদিল্লি যাওয়ার সময় বহির্গমন গেট থেকে পাপিয়া (২৮), তাঁর স্বামী মফিজুর রহমান (৩৮), মফিজুরের ব্যক্তিগত সহকারী সাব্বির খন্দকার (২৯) ও পাপিয়ার ব্যক্তিগত সহকারী শেখ তায়্যিবাকে (২২) গ্রেপ্তার করা হয়।
পরে তাদের বিরুদ্ধে জাল টাকা, অস্ত্র ও মাদকের মামলা হয়। এসব মামলায় তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডও মঞ্জুর করেন আদালত। তবে এর মধ্যেই রাজনীতিবিদ, আমলাসহ সমাজের বেশকিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির নাম পাপিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন ছাপা হয়; পরে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানো হয়।
যদিও এ নিয়ে পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সতর্ক করে দিয়ে বলা হয়, পাপিয়াসহ চারজন ‘গ্রেপ্তারের পর থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাম ও উৎস উল্লেখ করে বিভিন্ন পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নামে বিভিন্ন প্রিন্ট, ইলেক্ট্রনিক, অনলাইন মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভ্রান্তিকর ও সম্মানহানিকর সংবাদ পরিবেশিত হচ্ছে। যা জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে এবং এতে সামাজিক বিশৃঙ্খলা তৈরি হচ্ছে।’
এর মধ্যেই সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান শিখর এ নিয়ে মামলা করেছেন বলে খবর এলো। মামলার নথিতে বলা হয়েছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫/২৬/২৯/৩১ ধারায় অভিযোগে মামলাটি দায়ের করা হয়েছে।
এজাহারে বলা হয়, “গত ২ মার্চ মানবজমিন পত্রিকায় মতিউর রহমানের নির্দেশে প্রতিবেদক আল-আমিন ‘পাপিয়ার মুখে আমলা, এমপি, ব্যবসায়ীসহ ৩০ জনের নাম’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করেন।’’
‘সেখানে সংসদ সদস্যদের মধ্যে ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী, রংপুর, কুষ্টিয়া ও মাগুরা জেলার একজন করে সংসদ সদস্য পাপিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।’
এজাহারে আরো বলা হয়, ‘এ ছাড়া অপর আসামিরা তাঁদের ফেসবুক আইডিতে পাপিয়ার খদ্দের ও সংশ্লিষ্টতায় মন্ত্রী, এমপি, আমলা এবং ব্যবসায়ীসহ অনেকে জড়িত মর্মে স্ট্যাটাসের মাধ্যমে তালিকা প্রকাশ করেছেন। যার মধ্যে বাদীর নাম আছে। ওইসব মিথ্যা মানহানিকর সংবাদ ও মন্তব্য বাদী জাতীয় সংসদে বসে গত ৪ মার্চ সন্ধ্যায় প্রত্যক্ষ করেন। তা প্রকাশের মাধ্যমে আসামিরা বাদী এবং সংসদ সদস্যদের সামাজিকভাবে হেয়-প্রতিপন্ন করে সুনাম ক্ষুন্ন করেছেন।’
কে এই পাপিয়া
নরসিংদী জেলা শহরের ভাগদী মারকাজ মসজিদ এলাকার বাসিন্দা পেট্রোবাংলার অবসরপ্রাপ্ত গাড়িচালক সাইফুল বারীর মেয়ে পাপিয়া। ২০০৯ সালে নরসিংদী সরকারি কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন তিনি। এরপর ২০১২ সালে স্নাতকে ভর্তি হয়েছিলেন। তবে স্নাতক শেষ করতে পারেননি তিনি।
পাপিয়ার ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা নিয়ে নানা ধরনের কথা শোনা যায় সেই সময়ের ছাত্রনেতাদের কাছে। কারো বক্তব্য, পাপিয়া ছাত্র রাজনীতিতে কখনোই সক্রিয় ছিলেন না। আবার কারো বক্তব্য, কলেজজীবন থেকেই পাপিয়া উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনে অভ্যস্ত।
যুব মহিলা লীগে পদ পাওয়ার আগেই পাপিয়া বিয়ে করেন নরসিংদী শহর ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক মফিজুর রহমান ওরফে সুমন চৌধুরী ওরফে মতি সুমনকে। পাপিয়ার সঙ্গে গ্রেপ্তার হয়ে তিনিও এখন পুলিশ রিমান্ডে আছেন।
পাপিয়াকে নিয়ে র্যাবের বক্তব্য
পাপিয়াকে গ্রেপ্তারের দিন সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাব ১-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাফী উল্লাহ বুলবুল জানান, হোটেল ওয়েস্টিনের ২১তলার প্রেসিডেন্ট কক্ষটি গত নভেম্বরে ভাড়া নেন পাপিয়া। তিনি গত তিন মাসে ওই কক্ষের ভাড়া পরিশোধ করেছেন প্রায় ৮৮ লাখ টাকা। ১৯তলায় একটি বার রয়েছে, যেটি তিনি পুরোটাই বুক করে নিতেন। সেখানে প্রতিদিন তিনি আড়াই লাখ টাকা মদের বিল পরিশোধ করতেন। সব মিলিয়ে দেখা যায়, গত তিন মাসে তিনি প্রায় তিন কোটি টাকা বিল পরিশোধ করেছেন হোটেল কর্তৃপক্ষকে।