‘পাপুল বলেছিলেন, সাগরের পানি শুকিয়ে যাবে, আমার টাকা শেষ হবে না’
প্রতারণা ও অন্যায্য লেনদেনের অভিযোগে কুয়েতে গ্রেপ্তার সংসদ সদস্য শহীদ ইসলাম পাপুলের দম্ভোক্তি সম্পর্কে ভুক্তভোগী একজন প্রবাসী শ্রমিক বলেছেন, ‘এমপি পাপুল সাহেব বলেছিলেন, কুয়েত সাগরের পানি শুকিয়ে যাবে কিন্তু আমার (পাপুল) টাকা শেষ হবে না। কুয়েতে ৩০ বছরে কাচের পাহাড় তৈরি করিনি যে ভেঙে যাবে। পাথরের পাহাড় তৈরি করেছি, যা কোনোদিন ভেঙে যাবে না।’
জাতীয় সংসদের এই সদস্যকে নিয়ে কুয়েত ও বাংলাদেশে আলোচনা-সমালোচনা যখন তুঙ্গে, ঠিক এই সময়ে তাঁর বিরুদ্ধে ‘প্রথম’ মানবপাচারের মামলার এজাহারে এই বয়ান দেন বাদী আবদুল আলীম (৪৩)। নওগাঁ সদরের এই বাসিন্দা গত মঙ্গলবার রাতে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মতিঝিল থানায় মামলাটি করেন।
মতিঝিল জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) জাহিদুল ইসলাম সোহাগ আজ বৃহস্পতিবার রাতে এনটিভি অনলাইনকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। পরে মামলার বাদী আবদুল আলীমের সঙ্গেও কথা হয় এই প্রতিবেদকের।
কুয়েত নিয়ে যাওয়ার আগের ও পরের কথা ও কাজে মিল না থাকার অভিযোগ এনে পাপুলসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলায় আবদুল আলীম বলেছেন, তিনিসহ পাঁচজন, প্রত্যেকে সাত লাখ টাকা করে মোট ৩৫ লাখ টাকা দিয়ে কুয়েতে যান ২০১৮ সালের জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে।
রাজধানীর ফকিরেরপুলের ১১৮ ডিআইটি এক্সটেনশন রোডের পঞ্চম তলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় পাপুলের ট্রাভেল এজেন্সির কার্যালয় ছিল বলে মামলায় উল্লেখ করেন বাদী আবদুল আলিম। প্রতিদিন আট ঘণ্টা কাজের কথা থাকলেও কুয়েতে ১৬ ঘণ্টা কাজ করতে হতো অভিযোগ করে তিনি বলেন, “প্রথম চার মাস আমাদেরকে বসিয়ে রেখে কোনো বেতন-ভাতা দেওয়া হয়নি। পরে প্রতিদিন ১৬ ঘণ্টা করে কাজ করিয়ে আমাদের ১০০ দিনার করে বেতন দিত। আমাদের ছুটি দিত না। একদিন কাজে না গেলে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হত। এমপি পাপুলের ‘মারাফি কুয়েতিয়া’ কোম্পানিতে প্রায় ২০ হাজারের উপরে লোক কাজ করত। সবাইকে আমাদের মতোই দুর্ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে।’’
আজ বৃহস্পতিবার রাতে আবদুল আলীম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আট ঘণ্টায় বেতন দেওয়ার কথা ছিল ১২০ ডিনার। কিন্তু আমাদেরকে জোর করে ১৬ ঘণ্টা কাজ করতে হত। এবং বেতন দিত ১০০ দিনার। কুয়েতে যাওয়ার পর প্রথম চার মাস আমাদেরকে কাজ দেয়নি। ভীষণ কষ্টে দিন কাটতো সে সময়। পরে এক বছর দুই মাস আব্দুল্লাহ মার্কেটে আমি কাজ করেছি।’
একপর্যায়ে কুয়েতের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এমপি পাপুলের প্রতিষ্ঠানটিকে অবৈধ বলে ঘোষণা করলে, সবাই কাজ হারান।
আবদুল আলীম বলেন, ‘এরপর আমিসহ কয়েকজনকে নেওয়া হল কুয়েত পুরানো এয়ারপোর্টে। বেতন দেওয়ার কথা ছিল ৮০ দিনার। কিন্তু আমাদেরকে এক টাকাও বেতন দিত না। এয়ারপোর্টে কুলির কাজ করে লোকজনের কাছ থেকে দু-এক দিনার করে পেতাম। সেখান থেকেও আট দিনার করে নিয়ে নেওয়া হত। একদিন টাকা না দিলে পরের দিন দুই দিনের টাকা একসঙ্গে কেটে নিত।’
এরপর ২০১৯ সালের ১০ জুন আব্দুল আলীম ও তাঁর সহকর্মীদের কুয়েতের সিআইডি আটক করে। তারপর তাঁরা একটি মামলাও করেন বলে জানান আব্দুল আলিম। তিনি আরো বলেন, ‘সিআইডি পুলিশ আমাদেরকে বলেছিল, এখানে আসতে যে সাত লাখ টাকা খরচ হয়েছে তা আমরা আপনাদেরকে ওই কোম্পানির কাছ থেকে ফেরত দিয়ে দেব। কিন্তু তা না দিয়ে ১৬ জুন আমাদের দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়।’
এই বিষয়ে জানতে চাইলে মতিঝিল জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) জাহিদুল ইসলাম সোহাগ বলেন, ‘মামলায় লক্ষ্মীপুর-২ আসনের এমপি কাজী শহীদুল ইসলাম পাপুল (৫৫) ছাড়াও আসামি করা হয়েছে পাপুলের সহযোগী মো. আবদুর রাশেদ (৫৪), মো. রেজাউল করিম (৪৫) এবং মনিরকে। এ ছাড়া অজ্ঞাতনামা আরো ১০-১২ জনকে আসামি করা হয়েছে। মামলায় ভুক্তভোগী আরো চারজনের নাম উল্লেখ করেছে বাদী।
তাঁরা হলেন, ময়মনসিংহের ভালুকা থানার মো. আমীর উদ্দিনের ছেলে মো. শাহ আলম (৩২), জামালপুরের মাদারগঞ্জের মো. আবদুস সামাদের ছেলে আপেল আহম্মেদ (৩২), রাজশাহীর চারঘাটের মো. কাজীমুদ্দিনের ছেলে মো. রুবেল হক (২২) এবং নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীর মৃত জোহার আলীর ছেলে মো. সোহাগ (৪০)।
যোগাযোগ করা হলে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ডিআইজি (সিরিয়াস ক্রাইম) ইমতিয়াজ আহমেদ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘এই মামলাটির তদন্তভার নেওয়ার জন্য আমরা আবেদন করবো। এমপি পাপুলের বিরুদ্ধে এটাই বোধহয় মানবপাচার আইনে প্রথম মামলা। মামলাটি আমাদের হাতে আসার পর আমরা দ্রুতই তদন্তে নেমে পড়ব।’