পাবনায় গণপূর্ত ভবনে মহড়ায় ব্যবহৃত সেই অস্ত্র জব্দ

Looks like you've blocked notifications!
পাবনা গণপূর্ত ভবনে অস্ত্রসহ ঢুকছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। ছবি : সংগৃহীত

পাবনা গণপূর্ত ভবনে অস্ত্র নিয়ে আওয়ামী লীগের একদল নেতার মহড়ার ঘটনায় দুইটি অস্ত্র জব্দ করা হয়েছে। গতকাল শনিবার গভীর রাতে পৌর আওয়ামী লীগের বিলুপ্ত কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক এ আর খান মামুন ও যুবলীগ নেতা শেখ লালু পাবনা সদর থানায় এসে তাঁদের অস্ত্র জমা দেন। পরে পুলিশ তালিকা করে এই অস্ত্র জব্দ দেখান।

পাবনার পুলিশ সুপার (এসপি) মহিবুল ইসলাম খান অস্ত্র জব্দের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

এদিকে বিষয়টি নিয়ে আজ রোববার পাবনা জেলা উন্নয়ন ও সমন্বয় কমিটির সভায় আলোচনা হয়। ওই সভায় পাবনা গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আনোয়ারুল আজিম অনুপস্থিত ছিলেন। তাঁর পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেন উপসহকারী প্রকৌশলী মো. আব্দুস সাত্তার। তবে সভায় তিনি কোনো কথা বলেননি।  

পুলিশ জানায়, পাবনা সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের বিলুপ্ত কমিটির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক ফারুক হোসেন, পৌর আওয়ামী লীগের বিলুপ্ত কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক এ আর খান মামুন ও পাবনা জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য শেখ লালু গত ৬ জুন দুপুর ১২টার দিকে সশস্ত্র অবস্থায় জেলার গণপূর্ত অফিসে ঢুকে মহড়া দেন।

ওই দিন অস্ত্র নিয়েই তারা কার্যালয়ের বিভিন্ন কক্ষে ঢোকেন। ওই সময় তাদের সঙ্গীরা বাইরে অপেক্ষায় ছিলেন। দুপুর ১২টা ১২ মিনিটের সময় তারা ফিরে যান। গত শনিবার ১২ জুন এ ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজটি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। এ ঘটনায় সারা শহরে তোলপাড় সৃষ্টি হয়।

ঘটনার প্রায় এক সপ্তাহ পর বিষয়টি জানাজানি হলে জেলার সর্বত্র গুঞ্জন সৃষ্টি হয়। অজ্ঞাত কারণে গণপূর্ত বিভাগ বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে বলে অভিযোগ ওঠে। তবে গতকাল শনিবার পাবনা পুলিশ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছে।

পাবনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নাছিম আহমেদ জানান, গত ৬ জুন রোববার দুপুরে আট থেকে নয়জনের একদল ব্যক্তি কমান্ডো স্টাইলে শহরের ছাতিয়ানীতে অবস্থিত পাবনা গণপূর্ত অফিসে ঢোকে। এদের মধ্যে মামুনের হাতে একটি শটগান এবং অপর একজনের হাতে আরেকটি অস্ত্র ছিল। তবে বিষয়টি নিয়ে গণপূর্ত বিভাগ অভিযোগ না করায় কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। পুলিশের পক্ষ থেকে পাবনা সদর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গণপূর্ত বিভাগের এক সহকারী জানান, ওই ঘটনার পর থেকে তাঁর মধ্যে মৃত্যু আতঙ্ক কাজ করছে। চরম আতঙ্কে অফিস করছেন। ওই দিনের ঘটনা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এমন কমান্ডো স্টাইলে ওনারা ঢুকেছেন তাতে সবাই ভয় পেয়েছেন। দুই-একজন বাদে ঢোকার সময় সবার মুখে মাস্ক এবং কয়েকজনের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো বস্তু ছিল। তারা সবাই নির্বাহী প্রকৌশলীকে খোঁজ করছিলেন এবং অফিসের অপর এক প্রকৌশলীর টেবিলে অস্ত্র রেখে নির্বাহী প্রকৌশলীর কক্ষে ঢোকেন। এ সময় নির্বাহী প্রকৌশলী অফিসের বাইরে ছিলেন। যারা অস্ত্র নিয়ে অফিসে এসেছিলেন তারা সবাই কেষ্টপুরের লোক ও ঠিকাদারী করেন। এ ছাড়াও এদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত বলে তিনি জানান।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাবনা গণপূর্ত বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানান, বিভিন্ন সময়ে সন্ত্রাসীদের নিয়ে প্রভাব বলয় তৈরি করে উন্নয়ন কাজের কোটি কোটি টাকার টেন্ডার নিজেদের আয়ত্বে নিতে চেষ্টা করেন ক্ষমতাসীন দলের নেতৃত্বে থাকা ঠিকাদাররা। তাদের দাপটে অনেক পেশাদার ঠিকাদার গণপূর্ত বিভাগে টেন্ডার জমা দিতেই পারেন না। এসব কারণে অফিসের প্রকৌশলী ও কর্মরতদের নিজেদের পক্ষে নিতে তারা নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করেন। গত ৬ জুনের ঘটনা তারই ধারাবাহিকতায় ঘটেছে।

পাবনা গণপূর্ত বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘ঘটনার দিন আমি অফিসে ছিলাম, প্রথমে তারা আমার কাছে আসে এবং আমার টেবিলে অস্ত্র রেখে নির্বাহী প্রকৌশলীর খোঁজ করেন। তবে তারা কারো সঙ্গে খারাপ আচরণ করেননি।’

এর চেয়ে আর বেশি কিছু বলতে মিজানুর রহমান অপরাগতা প্রকাশ করেন। তিনি নির্বাহী প্রকৌশলীর সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন।

এ ব্যাপারে পাবনার গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আনোয়ারুল আজিম বলেন, ‘ঘটনার দিন আমি অফিসের বাইরে ছিলাম। পরে অফিসে এসে সিসিটিভি ফুটেজে অস্ত্র হাতে ওইসব ব্যক্তিকে দেখেছি। এ ছাড়া অফিসের লোকজনও আমাকে বিষয়টি সম্পর্কে বলেছেন। এই সশস্ত্র মহড়া ছাড়া পরে তারা কোনো হুমকি-ধামকি দেননি। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও গণপূর্ত বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে বলেও তিনি জানান। 

আনোয়ারুল আজিম আরও বলেন, মহড়া দেওয়া ছাড়া অন্য সমস্যা না হওয়ায় বিষয়টি নিয়ে আমরা বেশি আগাইনি।

পাবনার পুলিশ সুপার মহিবুল ইসলাম খান বলেন, ‘গণপূর্ত বিভাগ বিষয়টি নিয়ে কোনো অভিযোগ করেনি। গণপূর্ত বিভাগ বিষয়টি নিয়ে কেন কোনো অভিযোগ করলো না তা রহস্যময়। ফেসবুকে সিসিটিভির ফুটেজ দেখে পুলিশ নিজ উদ্যোগে কাজ করছে। শনিবার রাতে দুই নেতার কাছ থেকে অস্ত্র দুইটি জব্দ করা হয়েছে। এই মহড়ায় লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গ করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিষয়টি তদন্তাধীন রয়েছে।

পাবনার জেলা প্রশাসক কবীর মাহমুদ বলেন, এ বিষয়ে তাঁকে জানানো হলেও সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে প্রতিকার বা ব্যবস্থা নিতে বলা হয়নি।

এ ব্যাপারে পাবনা সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের স্থগিতকৃত কমিটির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক আলহাজ ফারুক হোসেন বলেন, ‘আমার কোনো দোষ নেই। আমি গণপূর্ত বিভাগে ঠিকাদারি করি না। নির্বাহী প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা বলার কথা বলে মামুন ও শেখ লালু আমাকে ডেকে নিয়ে গেছে।’

জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য শেখ লালু বলেন, ‘নিরাপত্তার স্বার্থে আমার লাইসেন্স করা অস্ত্র স্থানীয় থানায় জমা দিয়েছি।’

পাবনা পৌর আওয়ামী লীগের স্থগিতকৃত কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক এ আর খান মামুন বলেন, ‘লাইসেন্স করা অস্ত্র আমার কাছে সবসময় থাকে। পুলিশ চাওয়া মাত্র আমি সেটি থানায় জমা দিয়েছি।

অপর একটি সূত্র জানায়, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের আবাসিক প্রকল্প গ্রিন সিটিসহ নানা প্রকল্পে গণপূর্ত বিভাগের প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার কাজ চলছে। এসব প্রকল্পের কাজের ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে নিজেদের ক্ষমতাবান প্রমাণ করতেই এই মহড়া।

সূত্র আরও জানায়, গত ৩০ জানুয়ারি পাবনা পৌরসভার নির্বাচনে নৌকা ও নারিকেল গাছ মার্কা প্রতীকে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। ১২২ ভোটে নারিকেল গাছ জয়লাভ করে। তারপর থেকেই নারিকেল গাছ মার্কার সমর্থকরা প্রতিটি অফিস আদালতে নিজেদের আধিপত্য প্রমাণ করতে এ ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে।