‘পৃথিবীতে আইছি ইট ভাঙার চাকরি নিয়ে’
স্কুলে না গিয়ে খুব ছোটকাল থেকে ইট ভাঙার কাজ শুরু করেন আসমা বেগম (৩২)। ইট ভেঙেই জীবনের অধিকাংশ সময় পার করেছেন। ইট ভাঙতে ভাঙতে আসমা বেগম বলেন, ‘পৃথিবীতে আইছি ইট ভাঙার চাকরি নিয়ে। মরার আগে ইট ভাঙার চাকরি শেষ হইবো না। জীবনডাই পার করলাম ইট ভাঙতে ভাঙতে।’
আজ শনিবার বিকেলে ঢাকার কদমতলীর ডিএন রোডের ঈগলুর গেট সংলগ্ন তেলকল নামক এলকায় ইট ভাঙতে ভাঙতে আসমা বেগম এনটিভি অনলাইনকে এসব কথা বলেন।
আসমা বেগম বলেন, ‘আব্বা মরে (মারা) যায় ছোট থাকতে। তখন আমি ঠিকমতো কথাও বলতে পারি না। তারপর থেকে ইট ভাঙার চাকরি শুরু করি। কত বছর থেকে ইট ভাঙা শুরু করছি তা মনে পড়ে না। জীবনডা এই একটা চাকরিতেই কেটে গেল। কিন্তু সারাদিন ইট ভেঙে ২০০ টাকার বেশি কামাইতে পারি না। ১০০টি ইট ভাঙতে পারলে ১০০ টাকা মজুরি পাই। এর ভেতর ১০টা ইটের টাকা আবার সরদার জাহানারা বেগমকে দিতে হয়। ইট ভেঙে শরীর চলে না। সংসারও চলে না ঠিকঠাক। আঘাতে আঘাতে পা দুটো আমার নষ্ট হয়ে গেছে।’
আসমার পাশে ইট ভাঙছিল রীনা খাতুন (৯)। দিনে অন্তত ৫০টি ইট ভাঙে রীনা। রীনা বলছিল, ‘স্কুলে যাইনি কোনোদিন। মা কখনো ভর্তি করে দেয়নি। আরো দু-বছর আগে থেকে ইট ভাঙি। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করি।’
রীনার মা নাজমা বেগম (৫৪) পাশেই ছিল। তিনি বলছিলেন, ‘স্বামী মারা গেছে পাঁচ বছর আগে। আমার ছেলে নেই। পাঁচ মেয়ে। চারজনের বিয়ে দিছি। রীনা ছোট। টাকার অভাবে ওরে স্কুলে দিতে পারিনি। মেয়েটা প্রতিদিন আমাকে ইট ভেঙে দেয়।’
শুধু এরা তিনজন নয়; এখানে অন্তত ৪০ জন নারীকে ইট ভাঙতে দেখা যায়। তবে এরা কেউ জানে না আগামীকাল রোববার ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’। কালও তারা ভোরে ঘুম থেকে উঠেই শুরু করবেন ইট ভাঙার কাজ। এসব নারী শ্রমিককে ১১০টি ইট ভাঙলে ১০০ টাকা দেওয়া হয়। ইট ভেঙে কেউ কেউ অবশ্য ৪০০ টাকা পর্যন্ত আয় করেন বলে দাবি করেন সরদার জাহানারা বেগম।
শনিবার বিকেলে রাজধানীর আবদুল গণি রোডের সচিবলায়ের সামনে দেখা যায়, অন্তত ২০ জন নারী মাথায় করে বালু টানছেন। হাজিরাভিত্তিক বেতন এসব শ্রমজীবী নারীদের। প্রতিদিন হাজিরা দিলে তাদেরকে ৪৩০ টাকা দেওয়া হয়। এরা মূলত সারা বছরই সিটি করপোরেশনের কাজ করেন।
এদের ভেতরে একজন রুকসানা আক্তার (৪৩)। ফেনী জেলা থেকে ঢাকায় এসেছেন দুই বছর আগে। এসেই শুরু করেন মাটি টানার কাজ। কিন্তু এক বছরের মাথায় তাঁর স্বামী আক্তারুজ্জামানের ক্যান্সার ধরা পরে। এখন তিনি ভিক্ষা করেন। কিন্তু ক্যান্সারের টাকা জোগাড় হয় না তাতে। মাথায় বালু টানতে টানতে রুকসানা বলেন, ‘শরীর জুত থাকলে রাতে-দিনে ১৬ ঘণ্টাও বালি টানি। অনেক কষ্ট হয় কিন্তু বাইচ্চা থাকতে হইলে কাজ করতে হয়।’
রুকসানার মাথায় বালুর ঝুড়ি তুলে দিচ্ছিলেন আঙুরবালা (৪৫)। তিনি ১০ বছর ধরে এই বালু-মাটি টানার কাজ করেন। আঙুরবালা বলেন, ‘আজ দেহ চলছে না। ভাবছিলাম কাল কাজে আসব না কিন্তু এই কাজ দ্রুত শেষ করতে হবে।’
নারী দিবসের কথা বললে আঙুরবালা ও রুকসানা এই ব্যাপারে কিছুই জানেন না বলে জানান। সে সময় তাদের পাশে ছিলেন সব-কন্ট্রাকটার জাবেদ আলী। জাবেদ আলী বলেন, ‘নারী দিবসেও তারা কাজ করবে। ঘরে বসে থেকে কী করবে? ৪৩০ টাকা পাবে। আমার সঙ্গে ৩০ জন নারী ও ৩০ জন পুরুষ কাজ করেন। আমি সবাইকে সমান মজুরি দেই। নারী-পুরুষ সমান সমান।’