পোড়া বাসে যাত্রী-স্টাফ ছিল না, মামলার এজাহার বলছে ‘ছিল’

Looks like you've blocked notifications!

রাজধানীর মতিঝিলের রূপায়ণ হাউজিং প্রজেক্টের সামনের রাস্তায় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) একটি দোতলা বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। গত বৃহস্পতিবার দুপুরের ওই ঘটনায় বিএনপি, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের ৪৫ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরো অনেককে আসামি করে একটি মামলা করেছে মতিঝিল থানা পুলিশ।

মামলার এজাহারে পুলিশ বলছে, গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিলে বাসটি দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে। গাড়িতে থাকা বাসের যাত্রী ও স্টাফরা গাড়ি থেকে বের হয়ে প্রাণে বেঁচে যায়।

ঘটনার দিন গাজীপুরের টঙ্গী থেকে বিআরটিসির বাসটি নিয়ে মতিঝিলের উদ্দেশে রওনা দেন চালক ও তাঁর সহকারী। ওই বাসের চালকের সহকারী ছিলেন মানিক মিয়া (৩৫)। এই ঘটনায় পুলিশের করা মামলার এক নম্বর সাক্ষী তিনি। বাসে থাকা যাত্রীদের নামিয়ে গেট বন্ধ করে চালক ও তাঁর সহকারী মানিক দুপুরের খাবার খেতে গিয়েছিলেন।

জানতে চাইলে মানিক মিয়া এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘টঙ্গী থেকে বাস নিয়ে আসতে আসতে বৃহস্পতিবার দুপুর সোয়া ২টা বেজে যায়। এরপর বাসটি মতিঝিলে বিআরটিসির কাউন্টার এলাকায় রেখে আমরা একটি হোটেলে খাবার খেতে যাই। ওই হোটেলে আমরা প্রায় খেতে ও রেস্ট নিতে যাই। যাওয়ার সময় বাসটির গেট লক করে যাই আমরা। কাউন্টার থেকে বেশ খানিকটা দূরে হোটেলটি। হোটেলে গিয়ে আমরা হাতমুখ ধুচ্ছিলাম মাত্র। এমন সময় একজন জানালেন, বাসে আগুন লেগেছে।’

মানিক মিয়া বলেন, ‘আগুন লাগার খবর শুনেই সব কাজ বাদ রেখে চলে যাই। গিয়ে দেখি বাসে আগুন জ্বলছে। তারপর পানি ও বালি ছিটিয়ে আমরা আগুন নিভাই। বাসে যখন আগুন লাগানো হয়, তখন বাসটিতে কোনো যাত্রী, ড্রাইভার ও হেলপার ছিল না। কারণ, বাসটি লক করা ছিল। আমরা খাওয়া-দাওয়া সেরে আবার টঙ্গীর দিকে যাব বলে ভেবে রেখেছিলাম। বাসটিতে কারা আগুন দিয়েছে তা আমি দেখিনি, জানতেও পারিনি। যদি জানতে পারতাম, তাহলে জীবন দিয়ে হলেও তাদের আটকাতাম।’

মামলার এজাহারে পুলিশের বলা কথার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মানিক মিয়া বলেন, ‘পুলিশ কেন এসব বলেছে আমি জানি না। তবে ওই সময় গাড়িতে কোনো যাত্রী ছিল না। এমনকি আমরাও ছিলাম না।’

বিআরটিসির দোতলা বাসে আগুন দেওয়ার মামলার আরেক সাক্ষী মো. মুশফিকুর রহমান (২৭)। তিনি ঘটনাস্থল রূপায়ণ হাউজিং প্রজেক্টের নিরাপত্তারক্ষী।

মুশফিকর রহমান এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘মতিঝিলের স্বাধীনতা ভবনের উল্টা দিকে বাসটি তালাবদ্ধ অবস্থায় রাখা ছিল। ড্রাইভার, হেলপার ও কোনো যাত্রী ছিল না বাসে। তালা মারা থাকায় আগুন নেভানোর সময় বাসের ভেতরে পানি ঢালতেও আমাদের সমস্যা হচ্ছিল। কে আগুন লাগিয়েছে তা আমি দেখিনি।’

এই বিষয়ে জানতে চাইলে মতিঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ ইয়াসির আরাফত খান এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘মামলার তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে বিস্তারিত জেনে তারপর জানাতে হবে।’

বিআরটিসির বাসে আগুনের ঘটনায় করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও মতিঝিল পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক (এসআই) মিন্টু কুমার। তিনি এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘বাসটিতে আগুন লাগার সময় দরজায় তালা লাগানো থাকলেও আগুন নেভানোর সময় ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় মানুষ তা ভেঙে ফেলে।’

গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বাসে আগুন দেওয়া হয়। ছবি : ফোকাস বাংলা

তবে মামলার এজাহারে পুলিশ বলছে, ৪৫ জন এজাহারনামীয় আসামিসহ অজ্ঞাতনামা আরো বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনসহ ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীরা কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশে বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত ঢাকা-১৮ আসনের জাতীয় সংসদের উপনির্বাচনকে বানচাল, নাশকতা, সরকারি সম্পত্তি বিনষ্ট, নৈরাজ্য সৃষ্টি ও মানুষ হত্যার উদ্দেশ্যে আসামিরা একত্রিত হয়। এরপর তারা মতিঝিল থানাধীন বাণিজ্যিক এলাকার রূপায়ণ হাউজিং প্রজেক্টের সামনে পাকা রাস্তার ওপরে থাকা বিআরটিসির দ্বিতল যাত্রীবাহী বাসের স্টাফ ও যাত্রীদের আগুনে পুড়িয়ে মারার জন্য গাড়ি ভাঙচুর করে আগুন লাগিয়ে দিলে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে। গাড়িতে থাকা বাসের যাত্রী ও স্টাফরা গাড়ি থেকে বের হয়ে প্রাণে বেঁচে যায়।

এজাহারে আরো বলা হয়েছে, মতিঝিল থানা পুলিশ ও থানা এলাকায় নিয়োজিত অন্য মোবাইল টিমের সদস্যরা আনুমানিক বিকেল ৩টার দিকে ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। এ সময় পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে দৌড়ে পালানোর সময় মো. জাকির হোসেন (৪৬) নামের একজনকে আটক করা হয় এবং অন্য আসামিরা পালিয়ে যায়। এরপর তাৎক্ষণিকভাবে আশপাশের লোকজনের সহায়তায় বাসের আগুন নিভিয়ে ফেলে পুলিশ। গাড়িতে ভাঙচুর করে বাসটির বাঁ পাশের গ্লাস ভেঙে ফেলে এবং আগুনে গাড়ির ডান পাশের অংশ পুড়ে যায়। যার ক্ষতির পরিমাণ দেড় লাখ টাকা।

এ ঘটনায় ওইদিন রাতে মতিঝিল থানায় মামলা করেন থানার উপপরিদর্শক (এসআই) রোকন উদ্দিন। মামলায় মানিক মিয়াকে ১ নম্বর, মুশফিকুর রহমানকে ২ নম্বর এবং সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মো. তোফাজ্জল হোসেনকে ৩ নম্বর সাক্ষী করা হয়।

গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ধারাবাহিকভাবে যাত্রীবাহী বাসে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনায় মোট ১৩টি মামলা হয়েছে। এ ছাড়া ওই দিনই ঢাকা-১৮ আসনের উপনির্বাচনের দুটি ভোটকেন্দ্রে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ও পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় আরো তিনটি মামলা হয়েছে। পুলিশের দায়ের করা মোট ১৬ মামলায় গতকাল পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৪৭ জনকে।

রোববার বিকেলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) জনসংযোগ শাখার উপকমিশনার (ডিসি) মো. ওয়ালিদ হোসেন এনিটভি অনলাইনকে বলেছিলেন, ‘যাত্রীবাহী বাসে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ডিএমপির শাহবাগ, পল্টন, মতিঝিল, বিমানবন্দর, উত্তরা পূর্ব, ভাটারা, খিলক্ষেত, মোহাম্মদপুর, সূত্রাপুর ও বংশাল থানায় মোট ১৩টি মামলা করা হয়েছে। পুলিশ বাদী হয়ে এসব মামলা করেছে।’

ডিসি ওয়ালিদ বলেন, ‘পুলিশের ওপর হামলা, সরকারি কাজে বাধা প্রদান ও ভোটকেন্দ্রে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় উত্তরা পূর্ব, কলাবাগান ও তুরাগ থানায় পৃথক তিনটি মামলা করা হয়েছে। এসব মামলায় এখন পর্যন্ত মোট ৪৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এছাড়া মামলায় এজাহারনামীয় পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। এসব মামলায় মোট ৫০০-এর অধিক আসামি রয়েছে।’

এসব মামলার আসামিদের পরিচয় সম্পর্কে গতকাল ওয়ালিদ হোসেন আরো বলেছিলেন, ‘রাজধানীতে কয়েকটি বাসে কারা অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটিয়েছে, বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে তাদের আমরা শনাক্ত করেছি। তারা একটি রাজনৈতিক দলের সদস্য এবং এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মী বলে আমরা জানতে পেরেছি। তাদের ধরার জন্য আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। পরবর্তী সময়ে যাতে এই ধরনের ঘটনা না ঘটে, তা নিয়ে আমরা সতর্ক অবস্থানে আছি। চেকপোস্টে কঠোর নজরসহ আমাদের গোয়েন্দা নজরদারি বাড়িয়েছি। বিস্তারিতভাবে ওই অগ্নিসংযোগের উদ্দেশ্য জানার জন্য আমরা চেষ্টা করছি।’