প্রণোদনার নামে প্রতারণা : ‘নিরীহ’ পাঁচ দিনমজুরের জামিন
‘প্রতারণার ফাঁদে পড়ে’ তিন মাসের বেশি সময় কারাগারে থাকা কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার বড়ভিটা ইউনিয়নের নওদাবস গ্রামের পাঁচ দিনমজুরকে জামিন দিয়েছেন হাইকোর্ট। আজ বুধবার বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মোহাম্মদ আলীর হাইকোর্ট বেঞ্চ তাদের এক বছরের জামিন মঞ্জুর করেন।
আসামিরা হলেন নওদাবস গ্রামের বিধবা ফুলমণি রাণি, রণজিৎ কুমার, প্রভাস চন্দ্র রায়, কমল চন্দ্র রায় ও নিখিল চন্দ্র বর্মণ।
আদালতে জামিন আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত দাস গুপ্ত।
শুনানিতে অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, ‘আমি যাদের জামিন আবেদন নিয়ে এসেছি, তারা সবাই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দরিদ্র মানুষ। তাদের বাড়ি কুড়িগ্রামে। তাদের করোনার প্রণোদনা দেওয়ার কথা বলে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। পরে সেখানে টাকা পাঠিয়ে উঠিয়ে নেওয়ার চেষ্টা হয়। এভাবে তাদের ফাঁসানো হয়েছে।’
তখন আদালত বলেন, মামলা তো হয়েছে গাজীপুরে। আদালত জানতে চান, আসামিরা কতদিন ধরে জেলে আছেন কতদিন?
তখন আইনজীবী বলেন, তারা ৩ জুলাই থেকে জেলে আছেন। তাদের কোনো অবলম্বন নেই।
জামিনের বিরোধিতা করে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত দাস গুপ্ত বলেন, এটা ব্যাংকের টাকা আত্মসাতের মামলা।
তখন হাইকোর্ট প্রকাশিত প্রতিবেদনসহ মামলার নথি দেখে বলেন, ‘যারা লুটপাট করেছে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হলো না। দিনমজুর সাধারণ মানুষকে কেন ফাঁসানো হলো?’ এরপর আদালত পাঁচজনকে এক বছরের জামিন দেন।
গত রোববার গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন যুক্ত করে পাঁচজনের জামিন চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করা হয়।
গত ১২ জুলাই একটি নিউজ পোর্টালে ‘প্রণোদনার কথা বলে ফাঁসিয়ে দিল ৫ কৃষককে’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার বড়ভিটা ইউনিয়নের নওদাবস গ্রামের বাসিন্দা রণজিৎ কুমার, প্রভাস চন্দ্র, কমল চন্দ্র রায়, সুবল চন্দ্র মোহন্ত। সহজ-সরল দিনমজুর ও খেটে খাওয়া এসব কৃষকের জীবন চলে দারিদ্র্যের চরম কষাঘাতে। তাদের কাছে হঠাৎ একদিন এসে হাজির হন স্বপন মিয়া নামে এক ব্যক্তি। অভাব ঘোচাতে তাদের সরকারি সহায়তা পাইয়ে দেওয়ার কথা বলেন স্বপন। বলেন, সহায়তা আসবে ব্যাংকে, তাই সোনালী ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে।
স্বপনের কথায় রাজি হয়ে যান রণজিৎ কুমার আর প্রভাস চন্দ্ররা। নিজের নামটুকুও লিখতে না পারা এসব কৃষকের নামে সোনালী ব্যাংক নাগেশ্বরী (কুড়িগ্রাম) শাখায় খোলা হয় সঞ্চয়ী হিসাব।
এরপর কাগজপত্র স্বাক্ষর করতে হবে বলে তাদের পাঁচজনকে ঢাকায় নিয়ে যান স্বপন মিয়া। সেখানে অনেক কাগজে আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে তাদের বাড়িতে ফেরত পাঠান। কিছুদিনের মধ্যে রণজিৎ কুমারের সঞ্চয়ী হিসাবে ৪৮ লাখ ৪৫ হাজার ৭২০ টাকা, প্রভাস চন্দ্র রায়ের হিসাব নম্বরে ৬৫ লাখ ৭২ হাজার ১২০ টাকা, সুবল চন্দ্রের হিসাব নম্বরে ৪০ লাখ ৭১ হাজার ৭২০ টাকা, কমল চন্দ্রের হিসাব নম্বরে ৪২ লাখ ৪৯ হাজার ৮৮০ টাকা এবং ফুলমণি রাণির হিসাব নম্বরে ৪৮ লাখ ৭০ হাজার ৫২০ টাকা জমা হয়।
তবে এত টাকা জমা হওয়ার খবর ওই কৃষকরা পাননি। গাড়ি ভাড়ার টাকা ছাড়া তেমন কোনো অর্থ সহায়তাও স্বপন মিয়া তাদের দেননি। সরকারি সহায়তা পাওয়ার আশায় তারা দিন গুনছিলেন।
জানা গেছে, গত ১ জুলাই গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলা হিসাবরক্ষণ অফিসের একটি ভুয়া অ্যাডভাইস দাখিলের মাধ্যমে জালিয়াতি করে সোনালী ব্যাংক থেকে দুই কোটি ৪৬ লাখ নয় হাজার ৯৬০ টাকা তুলে নেওয়ার চেষ্টার অভিযোগে নয়জনের নামে মামলা হয়েছে। গাজীপুর জেলার শ্রীপুর থানায় মামলাটি করেন সোনালী ব্যাংক শ্রীপুর থানা হেডকোয়ার্টার শাখার ব্যবস্থাপক রেজাউল হক। সেই মামলায় নয়জনের মধ্যে পাঁচজন হলেন রণজিৎ কুমার, প্রভাস চন্দ্র, কমল চন্দ্র, ফুলমণি রাণি ও নিখিল চন্দ্র বর্মণ।
এ মামলায় অভিযুক্ত অন্য ব্যক্তিরা হলেন- গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা বজলুর রশিদ, অফিসের অডিটর আরিফুর রহমান, মাস্টাররোলে কর্মরত তানভীর ও ঢাকার উত্তরখান জামতলা এলাকার শাহেনা আক্তার।
মামলার বিবরণে জানা যায়, গত ১৭ জুন গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলা হিসাবরক্ষণ অফিসারের স্বাক্ষর করা অ্যাডভাইসের মাধ্যমে পাঁচটি বিল পরিশোধের (সরকারি চাকরিজীবীর আনুতোষিক) জন্য মোট দুই কোটি ৪৬ লাখ নয় হাজার ৯৬০ টাকা প্রদানের নিমিত্তে অভিযুক্ত কর্মচারী তানভীর অ্যাডভাইসের হার্ডকপি ব্যাংকে নিয়ে আসেন।
মোটা অংকের টাকা হওয়ায় নিয়ম অনুযায়ী এ সময় ব্যাংক থেকে হিসাবরক্ষণ অফিসে ফোন করার পর অভিযুক্ত হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা বজলুর রশিদ এসব অ্যাডভাইসের নিশ্চয়তা দেন। অ্যাডভাইস অনুযায়ী, সোনালী ব্যাংক নাগেশ্বরী শাখায় রণজিৎ কুমারের সঞ্চয়ী হিসাবে ৪৮ লাখ ৪৫ হাজার ৭২০ টাকা, প্রভাশ চন্দ্রের হিসাব নম্বরে ৬৫ লাখ ৭২ হাজার ১২০ টাকা পাঠানো হয়। এ ছাড়া সুবল চন্দ্রের হিসাব নম্বরে ৪০ লাখ ৭১ হাজার ৭২০ টাকা, কমল চন্দ্রের হিসাব নম্বরে ৪২ লাখ ৪৯ হাজার ৮৮০ টাকা, ফুলমণি রাণির হিসাব নম্বরে ৪৮ লাখ ৭০ হাজার ৫২০ টাকা প্রদান করা হয়।
পরদিন ব্যাংক কর্মকর্তাদের সন্দেহ তৈরি হলে তারা নাগেশ্বরী (কুড়িগ্রাম) সোনালী ব্যাংকের শাখার সঙ্গে যোগাযোগ করে হিসাব নম্বরগুলো যাচাই করেন।
এতে জানা যায়, হিসাবধারীরা সরকারি চাকরিজীবী নন; তারা প্রত্যেকেই দরিদ্র কৃষক ও দিনমজুর। পরে উপজেলা হিসাবরক্ষণ অফিসে অধিকতর খোঁজ নিলে জুনিয়র অডিটর খলিল উদ্দিন ‘এ বিলে ঝামেলা রয়েছে’ বলে জানান। পরে জালিয়াত চক্রের এমন কাণ্ডে দ্রুত ‘নো পেমেন্ট’-এর জন্য সোনালী ব্যাংক নাগেশ্বরী শাখাকে বলা হয়।
এরপর আসামি শাহেনা আক্তার সোনালী ব্যাংক উত্তরখান শাখা থেকে উক্ত টাকাগুলো উত্তোলনের জন্য নাগেশ্বরী শাখার চেকগুলো জমা দেন। ব্যাংক কর্তৃপক্ষের চতুরতায় শেষ পর্যন্ত সরকারি টাকা হাতিয়ে নিতে পারেনি জালিয়াত চক্র।
এ ঘটনা প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় ২৯ জুন হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা বজলুর রশিদ বিলটি স্থগিত রাখার জন্য চিঠি পাঠান। যদিও তিনি প্রথমে এ বিল ছাড় করার জন্য ব্যাংক কর্মকর্তাদের বলেছিলেন।