বন্দুক নিয়ে কলেজে অধ্যক্ষের মহড়া, ৯৯৯ কলে পুলিশ এসে নিয়ে গেল থানায়
গুলিভর্তি বন্দুক দেখিয়ে নিজ কলেজের সহকর্মী শিক্ষকদের প্রাণনাশের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে এক কলেজ অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে। এসময় ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে দিগ্বিদিক ছুটতে থাকেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। ঘটনা বেগতিক দেখে কলেজ থেকেই ফোন দেওয়া হয় জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯- এ। খবর পেয়ে কলেজে আসে পুলিশ। বন্দুক-গুলিসহ অধ্যক্ষকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নেওয়া হয় থানায়। এই খবর শুনে থানা চত্বরে এসে অবস্থান নেন শিক্ষকেরা।
গতকাল সোমবার (৬ মার্চ) দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলায় এ ঘটনা ঘটে। আলোচিত এই ঘটনা ঘটিয়েছেন উপজেলার চড়ারহাট শহীদ স্মৃতি মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ গোলাম মোস্তফা।
মহাবিদ্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, গত ১১-১২ মাস অনুপস্থিত থাকার পর অধ্যক্ষ গোলাম মোস্তফা একনলা একটি বন্দুক ও সাত রাউন্ড গুলি নিয়ে গতকাল সোমবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে কলেজে আসেন। এসময় তিনি পিয়নের মাধ্যমে সহকর্মী শিক্ষকদের দ্বিতীয় তলায় ডেকে নেন। একপর্যায়ে তিনি শিক্ষকদের বলেন, আমি হাইকোর্টের রায় পেয়েছি। আপনারা বিল-বেতন শিটে স্বাক্ষর করবেন। যদি না করেন তাহলে আমি আপনাদের গুলি করে দিব। এসময় তিনি বন্দুক উঁচিয়ে গুলি করার হুমকি দিলে শিক্ষকেরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। এই পরিস্থিতি দেখে একজন শিক্ষক কলেজ থেকে ৯৯৯-এ কল দেন। দ্রুত সেখান থেকে নবাবগঞ্জ থানায় বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হয়। খবর পেয়ে থানা থেকে পুলিশ কলেজে রওনা দেন। কিছুক্ষণ পর পুলিশ কলেজে উপস্থিত হয়ে অধ্যক্ষকে থানায় নিয়ে আসেন। প্রায় ৮ ঘণ্টা থানায় রাখার পর সন্ধ্যা ৭টায় তাকে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।
মহাবিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের শিক্ষক মিজানুর রহমান বলেন, ‘অস্ত্র নিয়ে কলেজে এসে অধ্যক্ষ ক্লাসরুম থেকে একজন শিক্ষককে বের করে দিয়ে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলেন, আমি এতোদিন কলেজে ছিলাম না। আমি হাইকোর্টের রায় পেয়েছি। এখন থেকে আমি তোমাদের অধ্যক্ষ। ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে অস্ত্র নিয়ে অধ্যক্ষ এভাবে কথা বলেন। এরপর তিনি আমাদের সবাইকে পিয়নের মাধ্যমে তার রুমে ডেকে নেন। এসময় আমরা তার কাছে গেলে তিনি বলেন, আমি হাইকোর্টের রায় পেয়েছি। আপনারা যদি বিল-বেতন শিটে স্বাক্ষর না করেন, তাহলে বন্দুক দিয়ে গুলি করে দিব। তার এরূপ আচরণ দেখে আমরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ি এবং আতঙ্কিত হয়ে ৯৯৯-এ ফোন দেই। পরে থানা থেকে পুলিশ এসে তাকে নিয়ে যায়।’
মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক এমদাদুল হক বলেন, অধ্যক্ষ এর আগেও অনেকবার বন্দুক নিয়ে কলেজে এসেছেন। তিনি কলেজে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে চান। আমরা তার বিচার চাই। এভাবে কলেজে ক্লাস নেওয়া আমাদের জীবন হুমকির মুখে পড়েছে। তিনি প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দিয়ে অপরাধ করেছেন।
নবাবগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফেরদৌস ওয়াহিদ বলেন, ‘৯৯৯ এর কল পেয়ে আমরা তাকে থানায় নিয়ে এসেছিলাম। সে তার বন্দুকের বৈধ কাগজ আমাদেরকে দেখিয়েছে। পরে তাঁকে আমরা ছেড়ে দিয়েছি। তবে বন্দুকটি তাঁর বাড়িতে রাখতে সমস্যা হওয়ায় সে বন্দুকটি আমাদের হেফাজতে রেখে গেছে। আমরা জিডি মূলে বন্দুকটি আমাদের অস্ত্রাগারে জমা রেখেছি।’
ওসি আরও বলেন, ‘কি কারণে কলেজে বন্দুক নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সে ব্যাপারে তার কাছ থেকে একটি লিখিত নেওয়া হয়েছে। এরপর সন্ধ্যা ৭টার দিকে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সে যদি কাউকে হুমকি দিয়ে থাকে তাহলে লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
অভিযোগের বিষয়ে অধ্যক্ষ গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘বন্দুকটি আমার লাইসেন্স করা। আমার দুটি বাড়ি হওয়ায় বন্দুকটি রাখা নিয়ে সমস্যা হচ্ছিল। এ কারণে গতকাল সোমবার থানায় জমা দেওয়ার জন্য বন্দুকটি নিয়ে বাড়ি থেকে রওনা দেই। এমন সময় আদিবাসী এক ছাত্র আমাকে কল করে বলে তার একটি প্রত্যয়নপত্রে আমার স্বাক্ষর লাগবে। সেই স্বাক্ষরটি দেওয়ার জন্য আমি কলেজে আসি। এসময় কলেজের শিক্ষক এমদাদুল হক গায়ে-পড়ে আমার সাথে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পর সেখানে পুলিশ উপস্থিত হয়ে আমাকে বলে কি হয়েছে। আমি তখন বলি তেমন কিছু না। এরপর আমি পুলিশের সঙ্গে থানায় এসে জানতে পারি কলেজ থেকে কে বা কারা ৯৯৯- এ ফোন দিয়েছে। পুলিশ আমার কাছে ঘটনা কি হয়েছে শুনে একটি লিখিত নিয়েছে। আমি সন্ধ্যায় বন্দুক, গুলি থানায় জমা রেখে চলে আসি। আমি কাউকে বন্দুক নিয়ে হুমকি দেইনি। কলেজের কিছু সমস্যা নিয়ে আদালতে মামলা-মোকদ্দমা চলছে। একারণে বিলের ঝামেলা হয়েছে। ফলে শিক্ষকেরা একটি মহলকে সঙ্গে নিয়ে আমার নামে মিথ্যা ষড়যন্ত্র করছে।’
গতকাল সোমবার বিকেলে থানা চত্বরে উপজেলার পুটিমারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান বলেন, ‘অধ্যক্ষ গোলাম মোস্তফা এই কলেজটিকে ধ্বংস করে দিয়েছে। সে প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে ভীতিকর অবস্থা সৃষ্টি করেছিল। তার এখানে দায়িত্ব পালন করার কোনো এখতিয়ার নাই। আমরা তার অপসারণ চাচ্ছি।’
উপজেলার চড়ারহাট শহীদ স্মৃতি মহাবিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সাবেক সভাপতি ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জিয়াউর রহমান মানিক বলেন, ‘মামলা-মোকদ্দমা করে অধ্যক্ষ গোলাম মোস্তফা শিক্ষকদের দীর্ঘ ১২-১৩ মাস বেতন বন্ধ করে রেখেছে। এসকল শিক্ষকেরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অধ্যক্ষের ভয়ে শিক্ষকেরা ভীতসন্ত্রস্ত ও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। প্রায় সময় সে অস্ত্র নিয়ে কলেজের এসে হুমকিধমকি দেয়। তারই ধারাবাহিকতায় আজও সে অস্ত্র নিয়ে এসে বিল-বেতন শিটে স্বাক্ষর নেওয়ার জন্য শিক্ষকদের গুলি করে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে।
এদিকে দিনাজপুর-৬ আসনের সংসদ সদস্য শিবলী সাদিক বলেন, এই কলেজের সমস্যাটি দীর্ঘদিনের। আমি এমপি হওয়ার পর থেকে এটা নিরসনের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সবখানে জানিয়েছি। তার বিরুদ্ধে তদন্ত এসেছিল। অনেক শিক্ষক তার নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। আজকের যেটা ঘটনা সেটা সরাসরি কিন্তু একটা কিলিং মিশনে তিনি এসেছিলেন। বিশেষ করে সবাইকে তাক করে লোডেড একটা গান সে সবাইকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করেছেন। আপনারা জানেন শুধু আঙুলের টাচটা লাগলেই হয়ত সেখানে ২-১ টা হতাহতের ঘটনা ঘটতে পারত। এটা নিয়ে তদন্ত হওয়া দরকার। সত্যিকার অর্থে এই মস্তিস্ক বিকৃতির মানুষ দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।