বাংলাদেশ-ভারত অংশীদারত্ব : পানিবণ্টন নিয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে চায় দিল্লি
বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী বলেছেন, ভারত ২০২১ সালে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক স্থাপনের ৫০তম বার্ষিকী উদযাপনের বছরে ছয়টি অভিন্ন নদীর পানি ভাগাভাগির বিষয়ে ‘খুব দ্রুত’ পদক্ষেপ নিয়ে দেখাতে চায় যে দুই দেশের মধ্যে অংশীদারত্ব এবং ভাগ করে নেওয়ার চেতনা খুব দৃঢ় রয়েছে।
এক সাক্ষাৎকারে ভারতীয় হাইকমিশনার বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে (ছয়টি অভিন্ন নদী) পানিবণ্টনে কোনো বাধা দেখছি না। আমি মনে করি, আমরা খুব দ্রুত এগিয়ে যেতে পারি। এখানে মূল বিষয় হলো হালনাগাদ তথ্য নিয়ে আসা।’
হাইকমিশনার আরো বলেন, ‘পানি সবার জন্য একটি সংবেদনশীল বিষয় এবং সবারই পানির প্রয়োজন। উভয় পক্ষই তথ্য সমন্বয়ের ওপর জোর দিয়েছে। তাই, আমাদের ও আপনাদের পক্ষের নিশ্চিত হওয়া উচিত যে তথ্যে দুপক্ষই একমত হয়েছে কি না।’
দোরাইস্বামী জানান, কারিগরি কমিটি পর্যায়ের বৈঠকটি জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হতে পারে এবং এরপর উভয় দেশ একসঙ্গে পানি ভাগাভাগির একটি বিস্তৃত কাঠামো তৈরি করতে পারে। কারিগরি কমিটির বৈঠকের পর পানি সম্পদ সচিবেরা আগামী বছরের মধ্যে এটিকে চূড়ান্ত করার চেষ্টা করবে এবং এই উদ্দেশ্য নিয়ে একটি বৈঠক করবে যাতে তারা দেখাতে পারে যে অংশীদারত্ব ভাগাভাগি চেতনা খুব দৃঢ় রয়েছে।
করোনা মহামারিতে সুযোগ থাকলে ২০২১ সালে যৌথ নদী কমিশনের সভা করার আশাবাদ ব্যক্ত করে ভারতীয় হাইকমিশনার বলেন, ‘আমরা পানি ভাগ করে নেব। আমরা বন্ধু, আমরা প্রতিবেশী। আমি মনে করি এটি খুব দ্রুত অগ্রসর হবে।’
ভারতীয় হাইকমিশনার আরো বলেন, ‘করোনা মহামারিতে পরিস্থিতি বুঝে আমরা দুই দেশের যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) বৈঠক বিষয়ে পুরোপুরি সমর্থন করছি।’
এর আগে, গত ১৭ ডিসেম্বরের ভার্চুয়াল সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুপক্ষের ২০১১ সালের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জরুরি ভিত্তিতে তিস্তা চুক্তি সইয়ের ওপর জোর দেন। অন্যদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়নে ভারতের আন্তরিক প্রতিশ্রুতি এবং তাঁর সরকারের অব্যাহত প্রচেষ্টার কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। দুই নেতা মনু, মুহুরী, খোয়াই, গোমতী, ধরলা ও দুধকুমার—এই ছয় অভিন্ন নদীর পানিবণ্টনের বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তির কাঠামো দ্রুত শেষ করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
এ সময় সেচের কাজে কুশিয়ারা নদীর পানি ব্যবহারের জন্য রহিমপুর খালের খনন কাজ যেন সীমান্ত সংশ্লিষ্ট ভারতীয় কর্তৃপক্ষ শেষ করতে দেয়, সে ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
এ বিষয়ে প্রস্তাবিত এমওইউ দ্রুত স্বাক্ষরের ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানিয়েছে ভারতীয় পক্ষ, যা করা হলে দুই পক্ষই কুশিয়ারা থেকে তুলে নেওয়া পানির পরিমাণ পর্যবেক্ষণ করতে পারবে।
এ ছাড়া শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) ইতিবাচক অবদানের কথা স্মরণ করেন এবং দ্রুতই সচিব পর্যায়ের পরবর্তী বৈঠক আয়োজনের কথা বলেন।
সীমান্ত ব্যবস্থাপনা
সীমান্ত হত্যা সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে ভারতীয় হাইকমিশনার বলেন, ‘মানুষের জীবন খুবই মূল্যবান এবং কাউকে আঘাত বা হত্যা করা উচিত নয়, তবে সমস্যাটি হলো সীমান্তের উভয় প্রান্তেই এটি ঘটছে।’
ভারতীয় হাইকমিশনার বলেন, ‘রাত ৯টা থেকে ভোর ৪টার মধ্যে ৯০ শতাংশ ঘটনা ঘটে এবং সীমান্ত বাহিনীর উদ্দেশ্য মানুষকে আঘাত করা নয়।’
হাইকমিশনার আরো বলেন, ‘আমরা একমত যে উভয় প্রান্তেই কোনো প্রাণ হারাতে হবে না। দুই দেশের সীমান্তবাহিনী বিএসএফ ও বিজিবির মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়ের মাধ্যমে উভয় পক্ষ সীমান্তে আরো বেশি সমন্বিত টহলে ভূমিকা পালন করতে পারে। আমাদের নাগরিক প্রশাসনকেও জড়িত করা দরকার এবং উভয় পক্ষের সীমান্ত এলাকার মানুষদের বোঝানো দরকার যে সীমান্ত পেরোবেন না, বেড়া কাটবেন না, এটি ঝুঁকিপূর্ণ এবং এটি মারাত্মক দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। এটিও সমন্বিত পদ্ধতিতে করা যেতে পারে।’
সীমান্ত হাটের ওপর জোর দিয়ে দোরাইস্বামী বলেন, ‘এটি মানুষকে বৈধভাবে কাজ করতে উৎসাহিত করবে। আমরা প্রচলিত যে বাস্তুতন্ত্র রয়েছে যাকে স্বীকৃতি দিতে পারি। এটি একটি মানবিক সমস্যা। এটি আইন-শঙ্খলা সমস্যা। তার মানে উভয়পক্ষকে একসাথে কাজ করতে হবে। ১৭ ডিসেম্বর শীর্ষ সম্মেলনের সময়ও উভয় নেতা এ বিষয়ে একমত হয়েছেন যে সীমান্তে নাগরিক প্রাণহানি উদ্বেগের বিষয় এবং সীমান্তরক্ষীদেরকে শূন্য পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে কাজ করার জন্য সমন্বিত ব্যবস্থা বাড়াতে হবে।’
বিজিবি-বিএসএফ সীমান্ত সম্মেলন শুরু গুয়াহাটিতে
ভারতীয় হাইকমিশনার জানান, নেতারা চলমান সমন্বিত সীমান্ত পরিচালনা পরিকল্পনার সম্পূর্ণ বাস্তবায়নের ওপর জোর দিয়েছেন। উভয় পক্ষই অস্ত্র, মাদক ও জাল টাকা চোরাচালান এবং বিশেষ করে নারী ও শিশুদের পাচার রোধে দুই সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলোতে সন্তুষ্টির কথা জানান।
ভ্যাকসিন সহযোগিতা
দোরাইস্বামী বলেন, ‘নেইবারহুড ফার্স্ট পলিসির আওতায় ভারত আশ্বাস দিয়েছে যে তাদের তৈরি করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাংলাদেশকে সরবরাহ করা হবে। দুদেশ এ ক্ষেত্রে বেসরকারি পর্যায়ে চুক্তিও করেছে। ভ্যাকসিনের জন্য আপনাদের নিজস্ব প্রক্রিয়া রয়েছে, আমি মনে করি চুক্তিটি এরই মধ্যে নির্দিষ্ট করে দিয়েছে যে প্রতি মাসে কতগুলো ভ্যাকসিন সরবরাহ করা হবে।’
দোরাইস্বামী জানান, তাঁরা সম্ভব হলে আরো বেশি কিছু করতে পারলে খুশি হবেন। কেবল ভ্যাকসিন সরবরাহ না করে উৎপাদন এবং সহযোগী উৎপাদন পর্যায়ে যাওয়ার জন্য তাঁরা চিকিৎসা পরীক্ষা করতে প্রস্তুত। ভারত ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ায় ভ্যাকসিন তৈরির সক্ষমতা কেবল বাংলাদেশেরই রয়েছে বলেও জানান হাইকমিশনার। তিনি বলেন, ‘এগুলো আমরা একসঙ্গে করতে পারি।’
রোহিঙ্গা সংকট
রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত যথেষ্ট কাজ করছে না এমন ধারণা প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে ভারতীয় হাইকমিশনার বলেন, ‘আমরা জানি না যে আমাদের কাছ থেকে কী করার প্রত্যাশা করা হয়, যেখন আমরা সবাই একমত যে এই দুর্ভাগা লোকদের অবশ্যই তাদের নিজ বাড়িতে ফিরে যেতে হবে। রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে যেভাবে প্রভাবিত করে, ভারতেও তার প্রভাব পড়তে পারে। সুতরাং আমরা কেন এই সমস্যার সমাধান চাইব না? আমরা আরো কী করতে পারি?’
হাইকমিশনার বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের রাখাইন রাজ্যে প্রত্যাবাসন বিষয়ে আমরা মিয়ানমারের বেসামরিক এবং সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রতিটি স্তরে কথা বলি, সেখানে আমাদের অবস্থানও স্পষ্ট।’
দোরাইস্বামী রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশের প্রশংসা করেন এবং বলেন, রোহিঙ্গাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এবং যত দ্রুত সম্ভব ফিরে যেতে হবে। শুধু ফিরে যাওয়া নয়, তাদের অবশ্যই সেখানে তাদের নিজের দেশে থাকতে হবে।
রোহিঙ্গা স্থানান্তরকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা না করার আহ্বান
ভারতীয় হাইকমিশনার দোরাইস্বামী বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয়েরই বন্ধু।’ দোরাইস্বামী জানান, সাম্প্রতিক ভার্চুয়াল সম্মেলনের সময় উভয় ভারত ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গাদের নিরাপদ, দ্রুত এবং স্থায়ী প্রত্যাবর্তনের গুরুত্বের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত ১১ লাখ মানুষকে আশ্রয় ও মানবিক সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উদারতার প্রশংসা করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ নিরাপত্তা কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে নির্বাচনের জন্য ভারতকে অভিনন্দন জানান। তিনি জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে বাংলাদেশকে সহযোগিতার কথা বলেন।
অংশীদারত্ব উদযাপন
কোভিড-১৯ পরিস্থিতির উন্নতি হলে ২০২১ সালের মার্চে বাংলাদেশ ও ভারত প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে সম্মেলন করার বিষয়ে আলোচনা করছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকী এবং বাংলাদেশ-ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০২১ সালের মার্চে ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ গ্রহণ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ধন্যবাদ জানান।
ভারতীয় হাইকমিশনার এ বিষয়ে বলেন, ‘আমরা একে অপরের সঙ্গে যা ভাগ করে নিতে পারি, অন্য কোনো দেশ তা করতে পারে না।