বিদেশি মোবাইলের লোভে অভিনয় করে শিশুকে হত্যা!

Looks like you've blocked notifications!
হবিগঞ্জে নির্মম হত্যার শিকার শিশু ইসমাইল হোসেন বিদয়। ছবি : সংগৃহীত

গত ১০ জানুয়ারি নিখোঁজ হয় হবিগঞ্জ শহরের তেঘরিয়া গ্রামের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র ইসমাইল হোসেন বিদয়। এরপর নানাভাবে চেষ্টা চালানো হলেও তাকে পাওয়া যাচ্ছিল না। এর দুদিন পর গত সোমবার খোয়াই নদীর পাশ থেকে উদ্ধার করা হয় তার লাশ। এরপরই এ ঘটনায় তদন্ত শুরু করে পুলিশ। তদন্তে বেরিয়ে আসে বিদয় হত্যার রহস্য।

পুলিশ জানায়, বিদেশ থেকে বিদয়ের বাবা তাকে একটি মোবাইল পাঠিয়েছিলেন। আর ওই মোবাইলটি হাতিয়ে নেওয়ার লোভেই তাকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে এক কিশোরকে আটক করেছে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে প্রায় এক মাসের পরিকল্পনায় বিদয়কে হত্যা করা হয়েছে বলে স্বীকার করে ওই কিশোর। সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নূরুল হুদা চৌধুরীর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এমন তথ্য দিয়েছে সে। তার স্বীকারোক্তির বরাত দিয়ে নিজ কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য দিয়েছেন পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ উল্ল্যা।

ইসমাইল হোসেন বিদয় উত্তর তেঘরিয়া গ্রামের সৌদিপ্রবাসী ফারুক মিয়ার ছেলে। সে স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ত। আটক কিশোর বিদয়ের প্রতিবেশী। সে হবিগঞ্জ জে. কে. অ্যান্ড এইচ. কে. হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণিতে পড়ে।

এসপি মোহাম্মদ উল্ল্যা জানান, গত ১০ জানুয়ারি শুক্রবার পোদ্দারবাড়ী এলাকায় একটি নাটক দেখার কথা বলে বাড়ি থেকে বের হয় বিদয়। প্রতিবেশী এক কিশোর তাকে নাটক দেখানোর কথা বলে নিয়ে যায়। কিন্তু রাত ৮টা বাজলেও ফিরে না আসায় বিদয়ের মা বিষয়টি তার চাচাদের জানান। এরপর বিদয়কে বারবার ফোন করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। আশপাশে খোঁজাখুঁজির পরও সন্ধান না পাওয়ায় বিদয়ের মা শাহেনা আক্তার ওই দিন সদর মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। এরপর বিভিন্ন পত্রিকায় নিখোঁজের সংবাদও ছাপা হয়। এ ছাড়া মাইকিংও করা হয়। এ ঘটনার পর বিষয়টি তদন্ত করতে থাকে পুলিশ।

এরই মধ্যে ১৩ জানুয়ারি সোমবার সকাল ১০টায় সদর উপজেলার লস্করপুর ইউনিয়নের চরহামুয়া গ্রামের পাশে খোয়াই নদীর কিনারায় একটি মরদেহ দেখতে পান স্থানীয়রা। বিষয়টি থানায় অবহিত করলে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মো. রবিউল ইসলাম, সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাসুক আলী, পুলিশ পরিদর্শক (অপারেশন) দৌস মোহাম্মদসহ পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে লাশটি উদ্ধার করেন। পরে পরিবারের সদস্যরা লাশটি ইসমাইল হোসেন বিদয়ের বলে শনাক্ত করেন।

হবিগঞ্জে শিশু ইসমাইল হোসেন বিদয় হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে গ্রেপ্তার কিশোর। ছবি : এনটিভি

পুলিশ জানায়, বিদয়ের মাথায় একাধিক আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। ময়নাতদন্ত শেষে লাশটি পরিবারের সদস্যদের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।

এ ব্যাপারে নিহত বিদয়ের চাচা মো. টেনু মিয়া গত মঙ্গলবার অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা করেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাসুক আলীকে নিযুক্ত করা হয়। পরে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রবিউল ও তদন্ত কর্মকর্তাসহ পুলিশের একটি দল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে তেঘরিয়া এলাকা থেকে হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে এক কিশোরকে গ্রেপ্তার করে। লাশ উদ্ধারের পর থেকেই পলাতক ছিল ওই কিশোর।

পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রবিউল ওই কিশোরকে নিবিড়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সে হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি স্বীকার করে। পরে গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় সে।

আদালতে ওই কিশোর জানায়, পাশের বাড়ির বিদয়ের হাতে এক মাস আগে একটি বিদেশি মোবাইল দেখে সে। মোবাইলটি বিদয়ের বাবা বিদেশ থেকে পাঠিয়েছিলেন। মোবাইলটি নিয়ে নদীর পাড়ে সহপাঠীদের সঙ্গে ছবি তুলত বিদয়। এ সময় ওই মোবাইলটির প্রতি লোভ হয় অভিযুক্ত কিশোরের। এ কারণে সে বিদয়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলে। গত শুক্রবার বিকেলে শহরের পোদ্দারবাড়ী এলাকায় নাটক দেখার জন্য বিদয়কে প্রস্তাব দেয় সে। এ ছাড়া বিদয়কে নাটকের ছবি ও ভিডিও করার পরামর্শও দেয় ওই কিশোর। এতে রাজি হয় বিদয়।

সে অনুযায়ী, বিকেল ৪টার দিকে বিদয়কে নিয়ে রওনা হয় ওই কিশোর। তারা ধুলিয়াখাল-মিরপুর রোডের মশাজান ব্রিজের ওপর সিএনজিচালিত অটোরিকশা থেকে নামে। বিদয়কে নিয়ে নদীর বেড়িবাঁধ দিয়ে ওই কিশোর তার নানাবাড়ি চরহামুয়া নোয়াবাদ যেতে থাকে। এ সময় নদীর বেড়িবাঁধের পাশের চরে সবজি ও শস্যক্ষেত দেখে ছবি তুলতে বললে বিদয় নদীর কিনারায় যায়। নাটকের মতো অভিনয় করার কথা বলে ওই কিশোর কলাগাছের ছোলা দিয়ে বিদয়ের দুহাত বাঁধে। এরপর বিদয়ের পা দুটিও বাঁধে ওই কিশোর। এ সময় পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী, ছবি তোলার ভান করে নদীর পাড়ে একটি বাঁশের মোড়া দিয়ে হত্যার উদ্দেশে বিদয়ের মাথায় উপর্যুপরি কয়েকটি আঘাত করে ওই কিশোর। এতে বিদয় গুরুতর আহত হয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এরপর বিদয়কে ধাক্কা দিয়ে খোয়াই নদীর পানিতে ফেলে দ্রুত মোবাইলটি নিয়ে নিজ বাড়িতে চলে যায় ওই কিশোর।

এসপি মোহাম্মদ উল্ল্যা বলেন, ‘বিদয়ের মোবাইল ফোনটি উদ্ধারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এ ঘটনায় আর কেউ জড়িত আছে কিনা, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’

সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রবিউল ইসলাম, ডিআইও-১ কাজী কামাল উদ্দিন, সদর মডেল থানার ওসি মো. মাসুক আলী, কোর্ট ইন্সপেক্টর আল-আমিন, এসআই মো. সাহিদ মিয়া প্রমুখ।