বিরোধ মীমাংসার নামে থানায় এনে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ

Looks like you've blocked notifications!
হামিদুর রহমানের মরদেহ। ছবি : সংগৃহীত

নওগাঁর পত্মীতলায় দাম্পত্য বিরোধ মীমাংসার নামে থানায় ডেকে হামিদুর রহমান (৫৫) নামের এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে ওই ব্যক্তিকে হত্যার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন পত্মীতলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শামসুল আলম শাহ।

নিহত হামিদুর রহমান পত্মীতলা সদর ইউনিয়নের কাটাবাড়ী বোরাম গ্রামের বাসিন্দা।

জানা গেছে, গত ২৫ এপ্রিল বিকেলে পত্মীতলা থানায় হামিদুর রহমানকে মারধরের এ ঘটনা ঘটে বলে জানা যায়। আজ বুধবার মৃত হামিদুরের লাশের ময়নাতদন্তের পর বিকেলে গ্রামের বাড়িতে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।

নিহত হামিদুরের স্বজনদের অভিযোগ, ১৫ থেকে ১৬ দিন আগে পারিবারিক বিষয় নিয়ে মনোমালিন্যের জেরে হামিদুর রহমান তাঁর স্ত্রীকে মৌখিকভাবে তালাক দেন। এই ঘটনার পর তাঁর দুই ছেলে মায়ের পক্ষ নিয়ে তাঁকে মারধর করেন। বিষয়টি নিয়ে হামিদুর রহমান তাঁর ছেলেদের বিরুদ্ধে থানায় লিখিত অভিযোগ করলে গত ১৭ এপ্রিল সমঝোতার কথা বলে পুলিশ উভয়পক্ষকে থানায় ডাকে। সেই সমঝোতা বৈঠকে হামিদুর তাঁর স্ত্রীকে মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। ওই ঘটনার পর গত ২৫ এপ্রিল হামিদুরের স্ত্রী ফাইমা থানায় গিয়ে অভিযোগ করেন প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী হামিদুর রহমান তাঁকে স্ত্রী হিসেবে এখনও মেনে নেননি। ওই অভিযোগের ভিত্তিতে ওই দিন পত্মীতলা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আশরাফুল ইসলাম সমঝোতার কথা বলে হামিদুরকে তাঁর বাড়ি থেকে উঠিয়ে নিয়ে যান। সেদিন পত্মীতলা থানায় হামিদুর-ফাইমা দম্পতি ছাড়াও তাঁদের অভিভাবক ও স্বজনরা উপস্থিত ছিলেন। সমঝোতা বৈঠকে কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে পত্মীতলা থানার ওসি শামসুল আলম শাহ্ লাথি ও ঘুষি মারতে শুরু করেন। এ সময় দেয়ালের সঙ্গে ধাক্কা লেগে মাথায় গুরুতর আঘাত পান হামিদুর রহমান। একপর্যায়ে হামিদুর রহমানকে থানাহাজতে বন্দি করে রাখা হয়। কিছুক্ষণ পর তাঁকে ছেড়ে দেয় পুলিশ। ওই ঘটনার পর মাথায় ও বুকে আঘাত পাওয়া হামিদুর বাড়িতে থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রক্তবমি শুরু হলে হামিদুর রহমানকে পত্মীতলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পরও হামিদুর রহমানের অবস্থার উন্নতি না হলে রাত ১১টার দিকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানকার জরুরি বিভাগের চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

পত্মীতলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা সাইফুল্লাহ খালেদ জানান, গতকাল মঙ্গলবার রাত ৮টার দিকে যখন হামিদুর রহমানকে হাসপাতালে আনা হয় তখন তিনি রক্ত বমি করছিলেন। এখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজশাহীতে পাঠানো হয়। ঠিক কী কারণে তাঁর মৃত্যু হয়েছে, এটা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পরই বলা যাবে।

মৃত হামিদুর রহমানের মা আছিয়া বেগম অভিযোগ করেন,  ‘হামিদুর রহমানের স্ত্রী ও ছেলেদের কাছ থেকে টাকা খেয়ে থানায় ডেকে নিয়ে পুলিশ তাঁকে মারধর করে। পুলিশের মারধরেই আমার ছেলের মৃত্যু হয়েছে। আমি এ হত্যার বিচার চাই।’

আছিয়া বেগম জানান, ২৫ এপ্রিল থানায় পুলিশের মারপিটে হামিদুর রহমানের বুকে ও মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পান। সেদিন বাড়িতে আসার পর তিনি বুক ও মাথার ব্যথার জন্য স্থানীয় গ্রাম্য চিকিৎসকের কাছ থেকে চিকিৎসা নিয়ে ওষুধ খাচ্ছিলেন। গতকাল মঙ্গলবার বিকেল থেকে তিনি বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে রক্তবমি শুরু করলে তাঁকে পত্মীতলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। সেখান থেকে রাজশাহী মেডিকেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানকার চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। 

২৫ এপ্রিল থানায় হামিদুর রহমানকে মারধরের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হামিদুরের খালাতো ভাই ফারুক হোসেন বলেন, ‘২৫ এপ্রিল থানায় তুলে নেওয়ার পর ওসি শামসুল আলম ও এসআই আশরাফুল হামিদুরকে তাঁর স্ত্রীকে মেনে নেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। কিন্তু হামিদুর কিছুতেই তাঁর স্ত্রীকে আর ঘরে তুলবেন না বলে তাঁদের জানান। হামিদুর জানান, স্ত্রীকে তিনি আর ঘরে নেবেন না। প্রয়োজনে যত দেনা-পাওনা সব পরিশোধ করবেন। এ কথা শুনে ওসি শামসুল আলম শাহ ক্ষিপ্ত হয়ে প্রথমে হামিদুরকে লাথি মারেন। পরে হামিদুর রহমানের বুকে ঘুষি মারলে ছিটকে গিয়ে দেয়ালের সঙ্গে তাঁর মাথায় ধাক্কা লাগে। মারার পর থেকেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। পুলিশের মারপিটের কারণেই অসুস্থ হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়েছে।’

ফারুক হোসেন আরও বলেন, ‘হামিদুরের মৃত্যুর ঘটনায় থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা নিতে চাইছে না। থানায় মামলা না নিলে আমরা এ ঘটনায় আদালতে মামলা করব।’

অভিযোগের বিষয়ে পত্মীতলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শামসুল আলম শাহ দাবি করেন, ‘সমঝোতার জন্য হামিদুরকে থানায় ডেকে নেওয়া হয়েছিল এ কথা ঠিক। কিন্তু তাঁকে থানায় কোনো মারধর করা হয়নি। থানায় মারধরের ফলে আঘাতপ্রাপ্ত হলে তাঁকে এখান থেকেই হাসপাতালে নেওয়া হতো। ঘটনার তিন দিন পর অসুস্থতার কারণে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। তারপরও এ ঘটনায় একটা অভিযোগ ওঠায় ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশে থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে এবং নওগাঁ সদর হাসপাতালে মৃত হামিদুরের লাশ ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করে স্বজনদের বুঝে দেওয়া হয়েছে।’

এ বিষয়ে পত্মীতলা সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আফতাব উদ্দিন বলেন, ‘মৃত্যু নিয়ে একটা অভিযোগ উঠায় বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। স্বজনদের সামনেই হামিদুর রহমানের লাশের সুরতহাল রিপোর্ট করা হয়েছে। লাশের শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। নওগাঁ সদর হাসপাতালে হামিদুর রহমানের লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে।’

আফতাব উদ্দিন আরও বলেন, ‘প্রাথমিক তদন্তে থানা পুলিশের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হয়েছে তার ভিত্তি পাওয়া যায়নি। অন্য কোনো রোগে হামিদুর রহমানের স্বাভাবিক মৃত্যুও হতে পারে।’