বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্য সংকটে সুনামগঞ্জের পানিবন্দি মানুষ
অতি বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকায় সুনামগঞ্জের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। জেলার চার পৌরসভাসহ ১১ উপজেলার বাড়িঘর, হাটবাজার, রাস্তাঘাটসহ বেশির ভাগ জায়গা এখন হাঁটুপানির নিচে। এতে করে জেলার প্রায় কয়েক লাখ মানুষ দ্বিতীয় দফায় পানিবন্দি হয়ে আছে। এ অবস্থায় খেয়ে না খেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে বন্যা কবলিত মানুষজন।
হাওর এলাকার বেশির ভাগ ঘরবাড়ি কাঁচা ও আধাপাকা হওয়ায় বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। তাই সেখানে বসবাস করা সম্ভব হচ্ছে না। অনেকেই আশ্রয়কেন্দ্র চলে যাচ্ছে। বেশির ভাগ মানুষ নিরুপায় হয়ে গবাদি পশু নিয়ে পানির মধ্যেই বাধ্য হয়ে থাকছে।
এদিকে, সব জায়গায় বন্যার পানি থাকায় দেখা দিয়েছে তীব্র বিশুদ্ধ খাবার পানির ও শুকনো খাবার সংকট।
সুনামগঞ্জ শহরের তেঘরিয়া এলাকার স্বেচ্ছাসেবী মো. আম্মার বলেন, ‘এক সপ্তাহ আগের বন্যার ধকল এখনো শহরের মানুষ কাটিয়ে উঠতে পারেনি, তার মধ্যে আবার বন্যা। আমাদের তেঘরিয়াসহ পৌর শহরের প্রায় জায়গাতে বন্যার পানি। মানুষ খুব কষ্ট করছে। এমনও অনেক পরিবার আছে ঘরে কোমর পানিতেও রয়ে গেছে। তাই প্রশাসন এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে অনুরোধ করছি তারা যেন একটু এসে দেখেন। তাহলেও মানুষ কিছুটা বাঁচতে পারবে।’
তাহিরপুর এলাকার সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘মেঘালয়ের পাহাড়ি ঢলে সব থেকে প্রথম ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহিরপুর এলাকা। ঢলে আশেপাশের সব রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। মানুষের বাড়িঘরে অনেক পানি উঠে গেছে। কাঁচা ঘরবাড়িতে থাকা মানুষের দুর্ভোগ বেশি হয়। সীমান্তে থাকার কারণে প্রশাসনের সহায়তাও পায় না। আর ঢলের সঙ্গে আসা বালু ঘরবাড়িতে ঢুকে যায় এবং ফসলি জমিতে গিয়ে পড়ে। তাই জমিতে আর ফসল ফলানো যায় না।’
ছাতক প্রেসক্লাবের সভাপতি মো. হারুন অর রশীদ চৌধুরী বলেন, ‘ছাতক একটি শিল্পনগরী। ছাতকের অংশে সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ১০০ সেন্টি মিটারের উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এই উপজেলার একমাত্র সড়কটি পানির নিচে তলিয়ে আছে, তাই সারা দেশের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে গত দুই দিন ধরে। এই উপজেলার সব ইউনিয়নের বাড়িঘর পানির নিচে। মানুষ ঘরবন্দি হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি দুইবার বন্যায় আঘাত করায় অনেক মানুষ কাজকর্ম হীন হয়ে ঘরের মধ্যে আটকে পড়েছে। তাই তাদের ঘরে খাবার দাবারও নেই।’
তবে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ বলেন, ‘সুনামগঞ্জে অতি বৃষ্টিপাত এবং ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জিতে বেশি বৃষ্টিপাত হওয়ায় পাহাড়ি ঢলে জেলার কয়েকটি পৌরসভা ও উপজেলায় বন্যা দেখা দিয়েছে। এখন পর্যন্ত প্রশাসনের পক্ষ থেকে জেলার দুর্গত এলাকায় ২৫৬টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। ওইসব আশ্রয়কেন্দ্রে রান্না করা খাবারসহ শুকনো খাবার দেওয়া হচ্ছে। ১৩ হাজার ৪৪টি পরিবার আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছে। এরই মধ্যে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে শুকনো খাবার ও ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৩৪৫মেট্রিক টন চাল এবং নগদ ছয় লাখ টাকা পৌরসভার মেয়রসহ স্থানীয় প্রতিনিধিদের মাধ্যমে দুর্গত এলাকায় দেওয়া হচ্ছে।’
জেলা প্রশাসক আরো বলেন, ‘এবার প্রশাসন আগাম প্রস্তুতি নেওয়ায় দ্বিতীয় দফার বন্যায় দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া গেছে। সেইসঙ্গে সরকারের কাছে বন্যা দুর্গতদের জন্য আরো বরাদ্দ চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।’
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেওয়া তথ্য মতে, আগামী আরো কয়েকদিন ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের সম্ভবনা রয়েছে। এতে করে বন্যা পরিস্থিতির আরো চরম অবনতি হবার আশঙ্কা করছে জেলাবাসী।
এমনিতেই দ্বিতীয় দফার বন্যায় নাজেহাল মানুষ, তার ওপর বন্যার আরো অবনতি হওয়ার খবরে চরম আতংক বিরাজ করছে।
বন্যার পানি সড়কের উপরে থাকায় জেলার সুনামগঞ্জ সদরের সঙ্গে তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর, দোয়ারাবাজার, জামালগঞ্জ এবং ছাতক উপজেলার সড়ক যোগাযোগ এখনো বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
এদিকে, সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সহিবুর রহমান বলেন, ‘গতকাল শনিবার রাত ৯টায়ও সুরাম নদীর পানি বিপৎসীমার ৫ সেন্টি মিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আগামী আরো দুএকদিন বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। তাই বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতির আশঙ্কা রয়েছে।’