বিষাদে মন ছুঁয়েছে আজ, তবু থেমে থাকেনি সময়
ভোর ভোর আবহে রমনার বটমূল থেকে পহেলা বৈশাখের আমেজ ছড়িয়ে পড়তো সারাদেশে। প্রাণের উৎসবে মেতে উঠতো বাঙালি জাতি। বাংলা বছরের প্রথম দিনকে মনে রাখার মতো করে উদযাপন করা বাঙালির চিরাচরিত স্বভাব। অথচ আজ বিষাদে ছুঁয়েছে মন। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস কেড়ে নিল সব আনন্দ-উল্লাস। শুধু কেড়ে নিয়েই কি ক্ষান্ত? ভাইরাসটি কপালে ভাঁজ ফেলেছে মৃত্যুচিন্তার!
বিষাদভরা মন নিয়ে মনে প্রশ্ন এসেছে অনেকেরই, আজ কি পহেলা বৈশাখ? আজই কি বাঙালির জাতীয় জীবনের এক আনন্দঘন দিন? এমন বৈশাখ কি বাংলাদেশ দেখেছে কখনো? আজ সেই মঙ্গল শোভাযাত্রা নেই। তবু সময় থেমে থাকেনি।এমন অনেক প্রশ্নকে সামনে রেখে বাংলা ১৪২৭ সনের যাত্রা হল।
আজ যেন রাস্তাঘাটও বিষাদে পরিপূর্ণ।কোলাহল নেই। ফাঁকা রাস্তায় শাড়ি-পাঞ্জাবি পরিহিত কপোত-কপোতী নেই। নেই গালে বৈশাখের ট্যাটু আঁকা। খোঁপায় ফুল গুঁজে রঙিন শাড়ি অথবা ফুল তোলা পাঞ্জাবি পরে আর কেউ নেই। মুড়ি-মুড়কি নেই। রাস্তার উপরে খেলনা সাজিয়ে বসে থাকা মৌসুমী বিক্রেতারা নেই। সব কিছুতেই আজ নেই নেই অবস্থা। তবে এরই মাঝে একাই সেজে বসে আছে প্রকৃতি। জনমানবহীন এই ঢাকা শহরের গাছের পাতারা আরো উজ্জ্বল, আরো সবুজ আর প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর হয়ে উঠেছে। কিন্তু প্রকৃতির এই সাজ আজ দেখার কেউ নেই।
এইসব কিছুর দায় কেবলই করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯)। সারাবিশ্বে আজ কাঁপুনি ধরিয়েছে এই প্রাণঘাতী ভাইরাস। চারিদিকের মৃত্যুর মিছিলে আজ শঙ্কিত প্রাণ। যেন প্রাণ আজ নেই প্রাণে। তবু শেষ সম্বল দিয়ে হলেও লড়ছে বিশ্ব। চিকিৎসা-বিজ্ঞান রাতদিন জেগে আছে প্রতিষেধকের খোঁজে। বেঁচে থাকার লড়ায়ে মরিয়া হয়ে উঠেছে পুরো বিশ্ব। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। এমন বিশ্ব তথা বাংলাদেশ কি কখনো দেখেছে কেউ?
যত ঝড়-ঝঞ্ঝাই আসুক, প্রাণঘাতী করোনা না এলে পহেলা বৈশাখে ঘরবন্দি রাখা যেত না কাউকে। এমন মনোভাব নিয়ে কথা বলছিলেন উম্মে সাবরিন। কথায় কথায় বলছিলেন, ‘আজ আমার ভালোবাসার প্রথম বার্ষিকী। অনেক স্বপ্ন ছিল, আজকের দিনে প্রেমিকের হাতে হাত রেখে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুরবো। কেক কাটারও ইচ্ছে ছিল। কিছুই হল না। আজ বিষাদে মন ভরে উঠেছে। চোখের দেখা একবার দেখতেও পেলাম না তাঁকে (প্রেমিক)। আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে হয় দূরভাষযন্ত্রের মাধ্যমে দেখেছি কিন্তু এমন দিনে হাতে হাত রেখে আর হাটা হল না!'
সদ্যবিবাহিত শাহিন হাওলাদার বলছিলেন, ‘প্রেম করে বিয়ে করেছি। বিয়ের আগে তিনটি পহেলা বৈশাখ কাটিয়েছি স্ত্রীর সঙ্গে। কিন্তু বিয়ের পর এটাই ছিল প্রথম পহেলা বৈশাখ। অথচ বেরই হতে পারলাম না। অথচ কত ইচ্ছে ছিল রমনার বটমূলে যাওয়ার। ইচ্ছে ছিল, শান্তির বারতা নিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নেওয়ার। কিছুই হল না।'
খুব আক্ষেপ নিয়ে ইয়ামিন সরকার নামের একজন বলছিলেন, ‘অনেকদিনের সখ ছিল পহেলা বৈশাখে শাড়ি পরে বের হব। কিন্তু হতে পারলাম না। তাই বাসায় বসে সেজেছি। শাড়ি-চুড়ি পরেছি। কিছুই তো করার নেই। এক করোনাভাইরাস আমাদের জীবনে স্তব্ধতা এনে দিয়েছে।'
শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসান বলেন, ‘সকাল থেকেই টিএসসিসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় টহল দিচ্ছি কিন্তু কাউকেই চোখে পড়েনি। ভেবেছিলাম কেউ কেউ হয়তো পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে বাহিরে বের হবে। কিন্তু কেউ বের হয়নি। রাস্তার ধরে কিছু ভ্রাম্যমাণ মানুষ আছেন যারা খাদ্য বা সহযোগিতা পাওয়ার আশায় বসে আছেন। শুধু এখানেই নয়, সারাদেশেই হয়তো একই অবস্থা।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. সাইফ উল্লাহ মুন্সী বলেন, ‘করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে হলে জনসমাগম এড়িয়ে চলতে হবে। বজায় রাখতে হবে শারীরিক দূরত্ব। বর্তমান পরিস্থিতিতে একা থাকায় মঙ্গল। সুতরাং পহেলা বৈশাখের দিনে পুরো অনুষ্ঠান বাতিল করা ছিল সরকারের এক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। না হলে পরিস্থিতি আরো ভয়ংকর হতে পারতো।'