ভক্তদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রীর হাসি

Looks like you've blocked notifications!
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছবি : সংগৃহীত

যুক্তরাষ্ট্রের রিট্জ-কার্লটন হোটেলের বলরুম। কালো স্যুট পরা মানুষের ভীড়ে গোলাপি জামা পরা ছয় বছর বয়সী মেয়েকে ওপরে তুলে ধরেছিলেন একজন। বললেন, ‘আমি মেয়েটাকে প্রধানমন্ত্রীকে দেখাতে চাই।’ নর্দার্ন ভার্জিনিয়ার ফার্স্ট গ্রেডে পড়ুয়া মেয়ে জয়াকে নিয়ে আবদুল্লাহ নিয়ামি গত সপ্তাহে একজন নারী সরকার প্রধান দেখাতে এসেছিলেন, যেটা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা সহসাই দেখতে পাচ্ছেন না।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন যুক্তরাষ্ট্রের রিট্জ-কার্লটন হোটেলে ছিলেন তখন ঘটে এ ঘটনা। লন্ডনে রানি এলিজাবেথের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠান শেষে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ভাষণ দিতে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছান। যেখানে বিশ্ব সম্প্রদায়ের বিবেকের প্রতি শান্তি স্থাপনের জন্য আবেদন জানিয়েছিলেন এই নারী শক্তির প্রতীক। খবর ওয়াশিংটন পোস্টের।

নারী হিসেবে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতাসীন একজন সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা, যিনি রাশিয়ার চেয়ে বেশি জনসংখ্যার একটি দেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি ২০টিরও বেশি হত্যাচেষ্টার হামলা থেকে বেঁচে গেছেন। আর এর মধ্যে একটি ছিল রক্তাক্ত গ্রেনেড হামলা, যা তাঁর আশপাশে থাকা মানুষের ভীড়ে চালানো হয়েছিল। আর এসব ছাপিয়ে তিনি একজন দাদি। নিজের ৭৬তম জন্মদিনটি তিনি পালন করছিলেন তাঁর ছেলে এবং ১৬ বছর বয়সী তাঁর নাতনির সঙ্গে।

একজন প্রধানমন্ত্রী হয়েও কীভাবে তিনি সাধারণ দাদি হয়ে ওঠেন প্রশ্ন করলে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি ওদের জন্য রান্না করি। মুরগির বিরিয়ানি রান্না করেছি আমার ছেলের বাসায়। আমার নিজেরও একটি রান্নাঘর আছে, যা কেবল আমার নিজের।’

ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘আমরা এসব জানতে পেরেছি তাঁর (শেখ হাসিনা) দীর্ঘ ভ্রমণ ও ব্যস্ত সময়ের ফাঁকে দেওয়া সামনা-সামনি একটি সাক্ষাতকারে।

আমরা খুব সুন্দর একটি কক্ষে বসেছিলাম, যেখানে ছিলেন একজন অনুবাদক ও তাঁর চিফ অব স্টাফ। আর ছিল তাঁর বাবা শেখ মুজিবুর রহমানের একটি বিশাল প্রতিকৃতি, যিনি ছিলেন দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, যাকে ১৯৭৫ সালে তাঁর পরিবারের ১৭ সদস্যসহ হত্যা করা হয়। শেখ হাসিনা হলেন তারই উত্তরাধিকারী, যিনি পরপর তিনবার দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন।

ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘তিনি (শেখ হাসিনা) একটি একটি জটিল ও বিক্ষুব্ধ জাতির নেতৃত্ব দিচ্ছেন, আর তিনিও একজন দূরদর্শী নেত্রী। জাতিসংঘে তাঁর ভাষণে শেখ হাসিনা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা দশ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে ফিরিয়ে নিতে বিশ্বসম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন—আশ্রয় শিবিরের জীবন ভালো নয়, তারা নিজ দেশে ফিরে যেতে চায়।’

যখন আমি এই বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলাম শেখ হাসিনা বললেন, ‘তাঁর দেশের অভিবাসন পরিস্থিতির সঙ্গে আমেরিকারটা মেলানো যাবে না। আমেরিকা…একটি বিশাল দেশ। দেশটির আছে প্রচুর খালি জায়গাসহ বিশাল ভূখণ্ড, আছে কাজ করার সুযোগ।’ তিনি এ সময় তাঁর হাত উত্তর থেকে দক্ষিণ বরাবর দেখাচ্ছিলেন আর বলছিলেন, কেন বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত।

শেখ হাসিনা আমাকে মনে করিয়ে দিলেন, বাংলাদেশ বিশ্বের অষ্টম জনবহুল দেশ যার রয়েছে ১৭ কোটি ১০ লাখেরও বেশি মানুষ। তিনি, বলেন ‘তবে আমাদের দেশটি ছোট।’ এ ব্যাপারে তার চিফ অব স্টাফ বলে ওঠলেন, ‘আমাদের আকার যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিনের সমান।’

রোহিঙ্গাদের অবস্থান ও দেশের অভ্যন্তরীন সন্ত্রাস দমনে দেশটির পুলিশ প্রশাসনের দমনপীড়নের কারণে আন্তর্জাতিক পরিসরে অবরোধসহ চাপের মুখে রয়েছে দেশটি। তবে, এই দমনপীড়ন হচ্ছে সেই ঘটনা, যার জন্য ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সন্ত্রাস দমনে শক্ত অবস্থান ও জিরো টলারেন্স নীতির কারণে শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। এটি ছিল শেখ হাসিনার জন্যে গর্বের একটি বিষয়।

যখন আমি তাকে এ বিষয়টি সম্পর্কে জিজ্ঞস করলাম তিনি (শেখ হাসিনা) একটু ঝুঁকে এসে ধীরে বললেন, ‘নারীরা পুরুষদের চেয়ে ভালো।’ বলেই হাসলেন তিনি। তবে, তিনি বিষয়টির গুরুত্ব তুলে ধরতেই তিনি বলে যেতে লাগলেন, তিনি বোঝেন দেশের নারীরা কী সমস্যার সামনা-সামনি হচ্ছে, তাঁরা মুখোমুখি হচ্ছেন দারিদ্র ও শিক্ষার সংগ্রামের। আর এই সমস্যাগুলো দেশের উন্নয়নকে কীভাবে বাঁধা দিচ্ছে।

গত এক যুগে শেখ হাসিনা উল্লেখযোগ্যভাবে তাঁর দেশের দারিদ্র কমিয়েছেন, শিক্ষার সুযোগকে বাড়িয়েছেন এবং বাসস্থানের ব্যবস্থায় পরিবর্তন এনেছেন।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘যাকে আমরা কুঁড়ে ঘর বলি, তা এখন আর নেই।’ যদিও তার দেওয়া ঘরগুলো সাধারণ কাঠামোর তৈরি-ইট আর টিনের ছাদের তৈরি আর এরই সঙ্গে বাংলাদেশ বাসস্থানকে মানবিক অধিকারের একটি হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। বিষয়টির গুরুত্ব বোঝাতে তিনি বলেন, ‘আমরা এগুলো করে দিচ্ছি পুরুষ ও নারীর নামে। আর যদি তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় তবে, ওই বাড়িটি নারীর মালিকানায় চলে যাবে পুরুষের নয়।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘স্বাস্থ্যসেবা ও বাসস্থান এই দুটি খাতে জাতিকে সামনে এগিয়ে নিতে আমাদের বিনিয়োগ অব্যাহত আছে।’ এগুলো হলো জাতিসংঘে দেওয়া তাঁর ভাষণের পরের কথা।

তবে, এ খবর খুব দ্রুতই সেখানে অবস্থানরত বাংলাদেশি নাগরিকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। তবে, এরই মধ্যে তিনি আমার সঙ্গে সাক্ষাতকার শেষ করলেন, আর আমি দেখতে পেলাম অভিজাত এই হোটেলটির লবি তাঁর ভক্তে পরিপূর্ণ যার মধ্যে ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী ৬৬ বছর বয়সী ইউসুফ চৌধুরী।  তিনি বলেন, ‘আমি সকাল ৬টায় বোসটন থেকে বিমানে উঠেছি।’ তিনি এ সময় তার হাতে থাকা একটি কার্ড দেখালেন, যা ১৯৭১ সালে দেশের হয়ে স্বাধীনতার যুদ্ধে অংশ নেওয়ার প্রমাণপত্র।

হোটেল স্টাফরা ছিলেন অভিভূত। নিরাপত্তাকর্মীরা ছিলেন এই পরিস্থিতিতে ২০টি হত্যা চেষ্টার মুখোমুখি হওয়া প্রধানমন্ত্রীর বিষয়ে কিছুটা ইতঃস্তত। সেখানকার লোকজন উল্লাস করছিল যেন এটি ১৯৬৬ সাল, আর শেখ হাসিনা বিটলসের একজন সদস্য।

ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তারা পরিকল্পনা সাজিয়ে ফেলল। শেখ হাসিনা বক্তৃতা দিতে রাজি হলেন। রিট্জ কর্তৃপক্ষ একপাশে ওল্ড ডমিনিয়ন রুমে তাদের চেয়ার-টেবিল সরিয়ে রাখলেন, আর নিরাপত্তাকর্মীরা খুব দ্রুত সারি করে প্রায় ২০০ মানুষকে বলরুমে জড়ো করে ফেললেন।

সমর্থকদের বেশিরভাগই ছিলেন পুরুষ। তবে, তার মধ্যে ছিল জয়া। সে গোলাপি জামা ও জামার সঙ্গে মিলিয়ে একই রংয়ের জুতো পরে ছিল।

আর ছিলেন ছুটির দিনে আসা ২৪ বছরের মালিহা জামান। মালিহা, যিনি দুবছর আগে মাস্টার্স শেষ করে বাংলাদেশ ছেড়েছিলেন। আর শেখ হাসিনাই সুযোগটি করে দিয়েছিলেন। এখন তিনি একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, আর ভার্জিনিয়ায় বসবাস করেন। এ সময় মালিহা যুক্তরাষ্ট্র কেন নারী প্রেসিডেন্ট পাচ্ছে না, তার কারণ বেশ কূটনৈতিক কায়দায় তুলে ধরেন।

আর এদিকে শেখ হাসিনাকে দেখতে মানুষ যেমন ভীড় এড়িয়ে আরও সামনে যাবার চেষ্টা করছিল, সেসময় আরেকজন নারী জানালেন কেন শেখ হাসিনা অনন্য। শাহেদা পারভিন নামের ওই নারী বলেন, ‘তিনি বয়স্ক মানুষদের আর শিক্ষা নিয়ে চিন্তা করেন। তিনি শিশুদের নিয়ে চিন্তা করেন, গর্ভবতী অনেক নারীদের নিয়ে ভাবেন। তিনি যেটা নিয়ে চিন্তা করেন, তা নিয়ে আমরা সবাই ভাবি।’