ভোলায় বাল্যবিয়ের কবলে হাজারও শিক্ষার্থী

Looks like you've blocked notifications!
ভোলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাস করছে শিক্ষার্থীরা। ছবি : এনটিভি

নভেল করোনাভাইরাস পরিস্থিতির দুই বছরে ভোলায় বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে হাজার হাজার শিক্ষার্থী। তাদের অনেকেই ঝরে পড়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে। এ সংখ্যা অন্তত ২২ হাজার বলে মনে করছেন জেলা শিক্ষা গবেষণা কর্মকর্তা মো. নুরে আলম সিদ্দিকী। বিয়ের ক্ষেত্রে আশ্রয় নেওয়া হয়েছে ভুয়া জন্মনিবন্ধনের। কাজিদের অর্থলোভ, ইভটিজিংয়ের ফলে নিরাপত্তার অভাব, সামাজিক অবক্ষয় ও প্রশাসনের উদাসীনতা বাল্যবিয়ের অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন গবেষকেরা। যদিও বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে অভিভাবকদের অসচেতনতাকে দায়ী করেছে প্রশাসন।

জেলা শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, ভোলার সাত উপজেলায় ৫৫০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। আর, এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী রয়েছে দুই লাখের বেশি।

জেলা শিক্ষা গবেষণা কর্মকর্তা মো. নুরে আলম সিদ্দিকী জানান, সপ্তম শ্রেণি থেকে শুরু করে দশম শ্রেণির ছাত্রীরা বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছে বেশি। অনেক ক্ষেত্রে আরও কম বয়সিরাও বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছে। তবে, বিয়ের ক্ষেত্রে যেহেতু জন্মনিবন্ধন কিংবা জাতীয় পরিচয়পত্রের প্রয়োজন হয়, তাই কাজিরা সচেতন হলে এ বিয়ে প্রতিরোধ করা সম্ভব। একই সঙ্গে অভিভাবকের সচেতনতার পাশাপাশি প্রশাসনের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

জানা গেছে, চলতি বছরের ৮ মার্চ জেলার তজুমদ্দিন উপজেলার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের অষ্টম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর বিয়ে হয়। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার প্রশংসাপত্র অনুযায়ী ওই শিক্ষার্থীর জন্ম ২০০৯ সালের ৫ জানুযারি। অথচ, কাবিননামায় বয়স দেখানো হয়েছে ২০০৪ সালের ৫ জানুয়ারি। আর, বিয়ে হয় তিন লাখ টাকা কাবিনে। বিয়ের পরদিন ৯ মার্চ সে জন্মদিনকে বৈধ করতে করা হয় নোটারি। বিয়ের রেজিস্ট্রেশনেও করা হয়েছে নয়-ছয়। অভিযোগ উঠেছে, স্থানীয় প্রতিনিধি ও উপজেলা প্রশাসনও জানতো বিষয়টি।

এ বিয়ের কাজি অ্যাডভোকেট মো. মহিউদ্দিনের কাছে জানতে চাইলে তিনি এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমার ক্ষতি করা আপনার ঠিক হবে না।’ এরপর তিনি চেম্বার ছেড়ে দ্রুত চলে যান।

জেলার তজুমদ্দিন উপজেলার চাচরা ইউনিয়নের একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী মোসা. লামিয়া ও আরিফা আক্তার বলেছে, ‘আমাদের অনেকেই বাল্যবিয়ের কারণে চলে গেছে। আমরা তাদের হারিয়েছি। আমরা তাদের হারাতে চাই না। বাল্যবিয়ে মুক্ত দেশ গড়তে চাই।

ছাত্রীরা অভিযোগ করেছে, জন্মনিবন্ধন কার্ডে বয়স বৃদ্ধির মাধ্যমে বিয়ে হচ্ছে। ইউনিয়ন পরিষদ সচিবেরা জন্মনিবন্ধন কার্ডে বয়স বাড়িয়ে তা প্রিন্ট করে দিচ্ছেন। এর মাধ্যমে বাল্য বিয়ে হচ্ছে। এ ছাড়া অর্থলোভী কাজিরা কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করেই বাল্যবিয়ে পড়াচ্ছেন।

একই ইউনিয়নের একটি ফাজিল মাদ্রাসার ছাত্রী মোসা. কারিমা আক্তার ও নুসরাত সুলতানা রিমা অভিযোগ করে বলছে, ‘আমরা বাল্যবিয়ে মুক্ত দেশ গড়তে চাই। কিন্তু, কিছু অসৎ লোকের জন্য এটা সম্ভব হচ্ছে না। টাকার বিনিময়ে পুলিশ প্রশাসনসহ সবাই ম্যানেজ হয়ে যায়। ফলে বাল্যবিয়ে আরও বৃদ্ধি পায়।’

এ ছাড়া শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়া-আসার পথে ইভটিজিংয়ের শিকার হচ্ছে উল্লেখ করে এ দুই শিক্ষার্থী জানায়, মান-সম্মান রক্ষায় মা-বাবা সন্তানকে বাল্যবিয়ে দিচ্ছে।

এদিকে, তজুমদ্দিন উপজেলার শম্ভুপুর ইউনিয়ন পরিষদে (ইউপি) গেলে সচিবের কক্ষে দেখা হয় মোসা. আসমা বেগমের সঙ্গে। এক সন্তানের মা আসমার বিয়ে হয় ২০২০ সালের ১৯ মে। দুই বছর আগে হুজুর ডেকে বিয়ে হলেও হয়নি কোনো কাবিন। দুই বছর পর আসমা আক্তার ইউনিয়ন পরিষদে আসে জন্মনিবন্ধন কার্ড করাতে।

বাল্যবিয়ে নিয়ে কাজ করে এমন সংস্থার একজন কর্মী ফারজানা জাহান বলেন, ‘বাল্যবিয়ে হলে আমাদের কিছু করার নেই। এমন কিছু ঘটার সময় আমরা প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও প্রতিষ্ঠান প্রধানকে অবহিত করি।

সাচড়া আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ইতি বেগম বলেন, ‘বাল্যবিয়ের কারণে সমাজের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। যে বাল্যবিয়ের শিকার, সে নিজেও তার সন্তানদেরও বাল্যবিয়ে দিবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।’ সচেতন করা হলেও কেন এমন হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না জানিয়ে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সেক্ষেত্রে কিছু করার থাকে না।’

উত্তর চাচড়া মোহাম্মদীয়া ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসার উপাধ্যক্ষ মো. নুরউদ্দিন, শম্ভুপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. জামাল উদ্দিন, কোড়ালমারা বাংলাবাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. কামরুল ইসলাম ও ভোলা সদর উপজেলার বন্ধুজন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. হারুন বাল্যবিয়েকে একটি মহামারির সঙ্গে তুলনা করেছেন। চরম ক্ষোভ প্রকাশ করে এসব শিক্ষকেরা বলেন, আমরা এসব ব্যাপারে প্রশাসনকে অবহিত করি। তারা এসে টাকা নিয়ে আবার চলে যায়। পরে বুক ফুলিয়ে সামনে দিয়ে হেঁটে যায়। ইউনিয়ন পরিষদ সচিবেরা এর সঙ্গে জড়িত। আমাদের স্বাক্ষর নেওয়ার কথা থাকলেও তারা সেটা করছে না। অনিয়মটা পরিষদ ও কাজিরা মিলে করছে। এভাবে চলতে থাকলে স্কুলশূন্য হয়ে যাবে।’

প্রতিষ্ঠান প্রধানেরা মনে করছেন, মা-বাবা দ্রুত বিয়ে দিয়ে চিন্তামুক্ত হতে চান। এসব ক্ষেত্রে রাজনৈতিক চাপের কথাও উল্লেখ করেন তাঁরা।

জনপ্রতিনিধি হিসেবে তজুমদ্দিন উপজেলার শম্ভুপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. রাসেল বলেন, যারা বাল্য বিয়ে দেবে, ওই ধরনের পরিবারকে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, ভিজিডি ও ভিজিএফসহ সরকারি সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করার পাশাপাশি নাগরিক সনদ বন্ধ করা সম্ভব।

অপরদিকে, তজুমদ্দিন উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মরিয়ম বেগম বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে জাল সার্টিফিকেট তৈরি করা হচ্ছে বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘মা-বাবা ও পরিবারের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। এর ফলে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করা সম্ভব।’