মসজিদে বিস্ফোরণ কিসে, দ্বিধায় মানুষ

Looks like you've blocked notifications!
নারায়ণগঞ্জ শহরের ফতুল্লার পশ্চিম তল্লা এলাকার বায়তুস সালাত জামে মসজিদে কেন এমন ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটেছে তার উত্তর খুঁজছেন স্থানীয়রা। ছবি : এনটিভি

নারায়ণগঞ্জ শহরের ফতুল্লার পশ্চিম তল্লা এলাকার ঘরে ঘরে এখন কান্নার রোল। যেন পুরো এলাকায় চলছে শোকের মাতম। গতকাল এশার নামাজের সময় বায়তুস সালাত জামে মসজিদের বিস্ফোরণের ঘটনায় সবশেষ ২০ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে শেখ হাসিনা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে ১৬টি লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে।   

আজ শনিবার বিকেলে পশ্চিম তল্লার বোমওয়ালা মাঠে একে একে আসতে থাকে লাশগুলো। মোট সাতটি লাশ আসে এখানে। তার আগে থেকেই সেখানে জড়ো হন নিহতদের স্বজন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজনসহ স্থানীয় হাজারো মানুষ।

নারায়ণগঞ্জ শহরের ফতুল্লার পশ্চিম তল্লা এলাকার বায়তুস সালাত জামে মসজিদে গতকাল এশার নামাজের পর ভয়াবহ বিস্ফোরণের চিহ্ন। ছবি : এনটিভি

বাকি লাশগুলো দেশের বিভিন্ন জেলায় চলে যায়। তাঁরা মূলত পশ্চিম তল্লা এলাকায় থেকে কাজকর্ম করতেন। তার পরও স্থানীয়রা উদ্যোগ নিয়ে এলাকার ১৯টি মসজিদ থেকে মোট ১৯টি গোসলের খাটিয়া ও ১৯টি লাশবাহী খাটিয়া এনে রেখেছিল। স্বজনরা সেই খাটিয়া ধরেই ডুকরে কাঁদেন, বিলাপ করেন। এখানে সান্ত্বনা দেওয়ার কেউ ছিল না। সবাই যেন কাঁদতে এসেছিলেন, একে অপরকে জড়িয়ে ধরে শুধুই কেঁদে নিজেদের কষ্ট লাঘবের চেষ্টা করছিলেন। পরিবেশ ছিল এমন ভারি, মর্মান্তিক- যা নিজের চোখে না দেখলে ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন।  

বুকফাটা কষ্টের মধ্যেও মানুষের ক্ষোভের প্রকাশ ছিল খুব স্পষ্ট। কেন এই বিস্ফোরণ? কার কারণে এখানে ঝরে গেল নিষ্পাপ এতগুলো প্রাণ? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে সবাই। কিন্তু সঠিক কোনো ব্যাখ্যা তাদের কেউ দিতে পারেনি। কেউ বলছে, বৈদ্যুতিক লাইনের শর্টসার্কিট থেকে ঘটনার সূত্রপাত। আবার কেউ কেউ বলছে, গ্যাস লাইনের লিকেজ থেকে এই ঘটনা ঘটতে পারে। যদিও এই ঘটনায় সবশেষ জেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ও তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।

পঞ্চাশোর্ধ্ব বজলুর রহমান পশ্চিম তল্লা এলাকার বাসিন্দা। তিনি এশার ফরজ নামাজ পড়ার পর বেতরের নামাজ শেষ করেন। তবে নফল নামাজ আদায় না করে তিনি মসজিদ ত্যাগ করেন। কারণ, তাঁর মুদি দোকান খোলা ছিল। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলছিলেন, ‘রাত ৮টা ১৫ মিনিটে জামাত শুরু হয়েছিল। শুরুর এক মিনিটের মধ্যে ফতুল্লার খানপুরের বৈদ্যুতিক লাইন চলে যায়। নামাজ চলাকালীন তল্লা এলাকার বৈদ্যুতিক লাইনের সংযোগ চালু করা হয়। কিন্তু সাড়ে ৮টার দিকে খানপুরের লাইনের বিদ্যুৎ পুনরায় চলে আসে। এর পরই দেখলাম, হঠাৎ বিকট শব্দে বিস্ফোরণ। এই দৃশ্য আর দেখার মতো না! আমার ধারণা, বিদ্যুতের লাইন থেকে স্পার্ক হয়েছে। তারপর সেখানে থাকা গ্যাসের কারণে এই ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।’

আজ শনিবার বিকেলে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার পশ্চিম তল্লার বোমওয়ালা মাঠে খাটিয়া নিয়ে লাশের জন্য মানুষের অপেক্ষা। ছবি : এনটিভি

এসব নিয়ে কথা হয় বায়তুস সালাত জামে মসজিদ কমিটির সভাপতি আবদুল গফুরের সঙ্গে। তিনি দুপুরে এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আট দিন আগে গ্যাস লাইনের লিকেজ আমাদের চোখে ধরা পড়ে। তারপর ছয়দিন আগে আমরা মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে তিতাস গ্যাসকে বিষয়টি জানাই। কিন্তু তিতাস থেকে আমাদের কাছে ৫০ হাজার টাকা চাওয়া হয়। তারপর তো আর সময়ই পাওয়া গেল না, দুর্ঘটনা ঘটে গেল। কিন্তু একটা ব্যাপার আমার মাথায় আসছে না, অনেক আগে মসজিদের নিচ দিয়ে গ্যাসের লাইন ছিল যেটা এখন আর নেই। নেই মানে, মূল লাইন থেকে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ তিনটি সাইড লাইন বন্ধ করে দিয়েছে। তাহলে মসজিদের ভেতরে কেন গ্যাস বুদবুদ করে উঠবে? এটা আমিও বুঝতেছি না।’

সোহেল রানা নামের একজন বলেন, ‘আমার ধারণা, প্রথমে বিদ্যুতের সমস্যা শুরু হয়েছে। পরে মসজিদের ভেতরে গ্যাস থাকায় বিস্ফোরণ হয়েছে।’

এসব ব্যাপারে জানতে চাইলে তল্লা এলাকার পিডিবির নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম মোরশেদ রাতে এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘একটি স্থানে বিদ্যুতের লাইনের সমস্যা থাকায় খানপুরের লাইনটা গতকাল রাত ৮ টা ১৭ মিনিটে অফ করে দেই আমরা। পরে সাড়ে ৮টার দিকে পুনরায় লাইনটা চালু করি। ৮ টা ৪০ মিনিটের দিকে আমরা খবর পাই, বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। তারপর পুনরায় লাইন অফ করে দেওয়া হয়। এই ঘটনার সঙ্গে বৈদ্যুতিক কোনো ঝামেলা নেই।’

আজ শনিবার বিকেলে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার পশ্চিম তল্লার বোমওয়ালা মাঠে এভাবেই এনে রাখা হয় খাটিয়া। ছবি : এনটিভি

প্রকৌশলী আরো বলেন, ‘তবে নানা স্থান থেকে বলা হচ্ছে, দুটি লাইনের সংযোগ থাকায় এই ঘটনা ঘটেছে। এটা সত্য নয়। বৈদ্যুতিক লাইন থেকে কিন্তু স্পার্ক হতেই পারে। সেটা সাধারণ ঘটনা। কিন্তু স্পার্কের সঙ্গে যদি গ্যাস লাইনের লিকেজ থাকে তাহলে কিন্তু ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে পারে। আমি জানি না, সেটা হয়েছে কি না। তবে আমাদের লাইনের কোনো সমস্যা ছিল না। এসিও কিন্তু বিস্ফোরিত হয়নি। বরং আগুনে পুড়ে গেছে। এবং আপনি দেখবেন, মসজিদের ভেতরে কোনো কালি নেই। যেটি গ্যাস থেকে আগুন লাগলে হয় না।’  

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আলী মো. আল মামুন দুপুরে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘গ্যাস লিকেজ ও লাইন মেরামত না করার বিষয়ে মুসল্লিদের অভিযোগ তদন্ত করা হচ্ছে। অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে দোষী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিস্ফোরণের ঘটনায় পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে।’

এ ব্যাপারে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক (ডিজি) সাজ্জাদ হুসাইন রাতে এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমরাও শুনেছি এই মসজিদে দুই এলাকার দুটি লাইন আছে। একটি লাইন চলে যাওয়ার পর আরেকটি লাইন কানেক্ট করা হতে পারে। সেসময় স্পার্ক হতে পারে। সেই স্পার্কও লিকেজ হওয়া গ্যাসের সংস্পর্শে এসে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। সেটাই হয়েছে, বলছি না। কিন্তু হতে পারে। আবার গ্যাসের লিকেজ থেকেও এই ঘটনা ঘটতে পারে। আসলে তদন্ত শেষ হলে সব জানা যাবে।’