আদালতে ৬ হাজার ২১১ পৃষ্ঠার রায়

‘মাসুদ রানা’ সিরিজের ২৬০টি বইয়ের লেখক শেখ আবদুল হাকিম

Looks like you've blocked notifications!

সেবা প্রকাশনীর পাঠকপ্রিয়  'মাসুদ রানা' সিরিজের ২৬০টি এবং 'কুয়াশা' সিরিজের ৫০টি বইয়ের লেখক হিসেবে শেখ আবদুল হাকিমকে স্বত্ব দিয়ে রায় দিয়েছেন আদালত। এতে করে দীর্ঘদিন পর এসব বইয়ের স্বত্ব পেতে যাচ্ছেন শেখ আবদুল হাকিম।

কপি রাইটস আদালতের বিচারক রেজিস্ট্রার অব কপিরাইটস জাফর রাজা চৌধুরী গতকাল রোববার এ-সংক্রান্ত মামলার দীর্ঘ শুনানি শেষে ছয় হাজার ২১১ পৃষ্ঠার রায় ঘোষণা করেন।

আদালতে বইয়ের স্বত্ব দাবি করে বাদীপক্ষে শেখ আবদুল হাকিম নিজে এবং বিবাদী কাজী আনোয়ার হোসেনের পক্ষে আদালতে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট জিল্লুর রহমান।

আদালতে মামলার অভিযোগের বিষয়ে কাজী আনোয়ার হোসেনের পক্ষে অ্যাডভোকেট জিল্লুর রহমান যুক্তি তুলে ধরে বলেন, “শেখ আবদুল হাকিম ১৯৬৭ সাল হইতে ২০০৮ সাল পর্যন্ত কাজী আনোয়ার হোসেন নির্দেশনায় মাসুদ রানা ও কুয়াশা সিরিজের ওপর বই লিখিয়াছেন এবং তিনি ২০১০ সালের প্রথম পর্যায় পর্যন্ত প্রতিপক্ষের নিকট হইতে তাহার প্রাপ্য টাকা নগদে গ্রহণ করিয়াছে।’

‘১৯৬৭ সন থেকে শেখ আবদুল হাকিম সেবা প্রকাশনীর ব্যানারে মাসুদ রানা ও কুয়াশা সিরিজের বই লিখেছেন। এতে প্রতীয়মান হয় যে, সেবা প্রকাশনী নিয়মিত চাকরি করতেন। সে চাকরিতে নিয়োজিত থেকে মালিকের নির্দেশে যে সকল বই লিখেছেন, তা তিনি স্বত্ব হিসেবে অধিকার করতে পারেন না, বইগুলি তার। তাই, কপিরাইট আইনমতে লঙ্ঘনজনিত অভিযোগটি অচল। তাই অভিযোগটি খারিজযোগ্য বটে।”

অন্যদিকে আদালতে বইয়ের স্বত্ব দাবি করে বাদীপক্ষে শেখ আবদুল হাকিম যুক্তি তুলে ধরে বলেন, “কাজী সাহেব আমার নিয়োগকর্তা নন, আমি তাঁর চাকরি করিনি। বইয়ের ভেতরে সর্বস্বত্ব প্রকাশকের লেখা থাকলেই সেটা প্রকাশকের হয় না। যেহেতু তিনি নিজেই বারবার বলেছেন তিনি লেখক নন, সে ক্ষেত্রে আমার লেখা বইগুলো কীভাবে তাঁর হলো, কোন ক্ষমতাবলে তিনি এক বই বারবার রিপ্রিন্ট করে সমুদয় টাকার মালিক বনে গেলেন, তা তাঁকেই প্রমাণ করতে হবে। তিনি কি কপিরাইট অফিস থেকে সব বই কপিরাইট করিয়ে নিয়েছিলেন? তিনি কি জানেন সর্বস্বত্ব প্রকাশকের লেখার পূর্বশর্ত কী? ‘প্রথম কথা, এই দরখাস্তের ১০ বছর আগেও কপিরাইট অফিসে আমি কাজী সাহেবের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেছি, সেখানে আমার লেখা মাসুদ রানা এবং কুয়াশার তালিকা অবশ্যই দেওয়া ছিল। তা ছাড়া আমি হলফনামার মাধ্যমেও তখনকার রেজিস্ট্রার মহোদয়কে সবিস্তারে জানিয়ে ছিলাম কী কী বই আমি লিখেছি। কুয়াশা-১০ সম্পর্কে মূল সত্য কাজী সাহেব খুব ভালো করে জানেন, ওটা আমারই লেখা। তবে এটাই সত্যি যে বইটা আমার বড় ভাই শেখ আবদুর রহমানের ছদ্মনাম সব্যসাচী নামে ওটা ছাপা হয়েছিল।”

শুনানি শেষে আদালত মূল রায়ে বলেন, ‘সুষ্ঠু সমাধান ও ন্যায়বিচারের স্বার্থে কপিরাইট বোর্ড বা বিজ্ঞ আদালত কর্তৃক পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ পর্যন্ত আবেদনকারী শেখ আবদুল হাকিমের দাবীকৃত ও তালিকাভুক্ত বইগুলোর প্রকাশ বা বাণিজ্যিক কার্যক্রম গ্রহণ থেকে বিরত থাকার জন্য প্রতিপক্ষকে (কাজী আনোয়ার হোসেন) নির্দেশনা দেওয়া হলো। এ ছাড়া প্রতিপক্ষকে আবেদনকারীর কপিরাইট রেজিস্ট্রেশনকৃত প্রকাশিত বইগুলোর সংস্করণ ও বিক্রীত কপির সংখ্যা এবং বিক্রয়মূল্যের হিসাব বিবরণী এ আদেশ জারির তারিখের পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে বাংলাদেশ কপিরাইট অফিসে দাখিল করতে নির্দেশ দেওয়া হলো।’

রায়ের বিষয়ে বাংলাদেশ কপিরাইট অফিসের বিচারক রেজিস্ট্রার জাফর রাজা চৌধুরী এনটিভি অনলাইনকে জানান, ২০১৯ সালের ২৯ জুলাই শেখ আবদুল হাকিম অভিযোগ করার পর অভিযোগকারী ও প্রতিপক্ষের আইনজীবীর উপস্থিতিতে শুনানি হয়। শুনানিতে আবদুল হাকিম লিখিতভাবে নিজেই তাঁর যুক্তি তুলে ধরেন। কাজী আনোয়ার হোসেনের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন তাঁর আইনজীবী। জাফর রাজা আরো বলেন, আনোয়ার হোসেন চাইলে ৯০ দিনের মধ্যে এ রায়ের বিরুদ্ধে আবেদন করতে পারবেন। এখানে তিনি হেরে গেলে হাইকোর্টে আপিল করতে পারবেন। তিনি আরো বলেন, প্রথম থেকে ২০টি সিরিজের লেখক কাজী আনোয়ার হোসেন। কাজেই বলা যায়, 'মাসুদ রানা'র ব্র্যান্ডিং কাজী আনোয়ার হোসেনই করেছেন, আবিষ্কারকও তিনি।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ কপি রাইটস অফিসের পরিদর্শক মো. আতিকুজ্জামান এনটিভি অনলাইনকে বলেন, প্রায় ১০ বছর আগে নিজেকে থ্রিলার সিরিজ 'মাসুদ রানা'র লেখক দাবি করে বাংলাদেশ কপিরাইট রেজিস্ট্রার অফিসে অভিযোগ জানিয়েছিলেন শেখ আবদুল হাকিম। বিষয়টি প্রথমে গুরুত্ব পায়নি। গেল বছর আবার অভিযোগ করেন। এক বছরের বেশি সময় ধরে আইনি লড়াই শেষে গতকাল রোববার বাংলাদেশ কপিরাইট অফিস আবদুল হাকিমের পক্ষে রায় দিয়েছেন। এর ফলে 'মাসুদ রানা' সিরিজের ২৬০টি এবং 'কুয়াশা' সিরিজের ৫০টি বইয়ের লেখক হিসেবে স্বত্ব পেতে যাচ্ছেন আবদুল হাকিম।

মামলার বিবরণে জানা যায়, লেখক শেখ আবদুল হাকিম অভিযোগ করেন, সেবা প্রকাশনীর জনপ্রিয় ধারাবাহিক 'মাসুদ রানা'র লেখক হিসেবে সবাই মূলত কাজী আনোয়ার হোসেনকেই জানেন। কিন্তু এ সিরিজের প্রথম ১৮টি বইয়ের পরের ২৬০টি বইয়ের লেখক তিনি নন। এর লেখক শেখ আবদুল হাকিম। অথচ একটি বই বাদে কোনোটিতেই কপিরাইট স্বত্ব নেই তাঁর। একইভাবে সেবা প্রকাশনীর আরেক জনপ্রিয় থ্রিলার সিরিজ 'কুয়াশা'রও ৫০টি বই আবদুল হাকিমের লেখা হলেও লেখক হিসেবে নাম রয়েছে কাজী আনোয়ার হোসেনের। বিষয়টি আমলে নিয়ে শুনানি শেষে রোববার রায় দেওয়া হয়।

আদালতের আদেশের পর শেখ আবদুল হাকিম বলেন, “‘মাসুদ রানা' ও 'কুয়াশা' সিরিজের লেখক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে এ দুর্যোগের সময়ও খবরটি আমাকে দারুণ আনন্দ দিয়েছে, আমি খুশি। ‘মাসুদ রানা’র ২৬০টি এবং ‘কুয়াশা’র ৫০টি বইয়ের লেখক হিসেবে আমি স্বীকৃতি পেয়েছি।”

অন্যদিকে এ বিষয়ে সেবা প্রকাশনীর পক্ষে কেউ মন্তব্য করতে রাজি হননি।