মোহাম্মদ নাসিমের বর্ণাঢ্য জীবন
বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী ছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। তিনি বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর এবং পঁচাত্তরে জেলখানায় হত্যাকাণ্ডের শিকার জাতীয় চার নেতার অন্যতম ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর ছেলে। মনসুর আলী মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত বাংলাদেশের প্রথম সরকারের অর্থমন্ত্রী এবং স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেন।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর স্ট্রোক করেন নাসিম। এরপর আজ শনিবার শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী নাসিম ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক। তিনি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
মোহাম্মদ নাসিম আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের এক পরিচিত মুখ। আন্দোলন সংগঠিত করতে তাঁর নেতৃত্বে অসংখ্য মিছিল-মিটিং হয়। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় তিনি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
মোহাম্মদ নাসিম ১৯৪৮ সালের ২ এপ্রিল সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলায় সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা শহীদ ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন। মোহাম্মদ নাসিমের মায়ের নাম মোসাম্মৎ আমিনা খাতুন। তিনি আমেনা মনসুর হিসেবেই পরিচিত। তিনি একজন গৃহিনী ছিলেন।
পারিবারিক জীবনে তিন সন্তানের জনক মোহাম্মদ নাসিম। তাঁর স্ত্রীর নাম লায়লা আরজুমান্দ। মোহাম্মদ নাসিম জগন্নাথ কলেজ (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
মোহাম্মদ নাসিমের বাবা শহীদ ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের হয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সিরাজগঞ্জ-১ আসন থেকে বিজয়ী হন। প্রাদেশিক পরিষদের মন্ত্রীও হন তিনি। ’৭০-এর নির্বাচনেও তিনি প্রাদেশিক পরিষদের প্রতিনিধি হিসেবে মনোনয়ন পান। দ্রুতই তিনি আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় নেতায় পরিণত হন। তিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের অর্থমন্ত্রী ও স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের যোগাযোগমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের উন্নয়নের পাশাপাশি তিনি নিজ এলাকার উন্নয়নে ভূমিকার কারণে এখনো সেখানকার মানুষের কাছে স্মরণীয়-বরণীয়।
বাবার পরে নিজেও রাজনীতিতে আসেন নাসিম। ১৯৮৬, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন তিনি। ২০০৮ সালে মোহাম্মদ নাসিম মামলাবিষয়ক জটিলতায় নির্বাচনে অংশ নিতে না পারায় ছেলে তানভীর শাকিল জয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তী সময়ে ২০১৪ সালে নাসিম সিরাজগঞ্জ-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। সর্বশেষ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি এই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।
১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালের আওয়ামী লীগ সরকারের সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন করেন নাসিম। ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান মোহাম্মদ নাসিম। তিনি খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন। আওয়ামী লীগের সব্বোর্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম প্রেসিডিয়ামের সদস্য নাসিম বর্তমানে ১৪ দলীয় জোটের মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। এর আগে তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
রাজনীতির পাশাপাশি সমাজকল্যাণমূলক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন শহীদ ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর সন্তান মোহাম্মদ নাসিম। ঢাকাসহ নিজ এলাকা সিরাজগঞ্জে বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন তিনি। সিরাজগঞ্জের অবকাঠামোসহ নানা উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড হয়েছে বর্ষীয়ান এই রাজনীতিকের হাত ধরে। সর্বশেষ করোনা পস্থিতিতেও তিনি আওয়ামী লীগ, ১৪ দলীয় জোট ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে ঢাকা ও নিজ নির্বাচনী এলাকায় অসহায় মানুষদের সহায়তা করেছেন।
দাদা এবং বাবার পথ ধরে জাতীয় সংসদে প্রবেশ করেন নাসিমের ছেলে তানভীর শাকিল জয়ও। জাতীয় সংসদে এই তিন প্রজন্মের ভূমিকা ও বক্তব্য নিয়ে একটি বই সম্পাদনা করেন মোহাম্মদ নাসিম। ‘সংসদে তিন প্রজন্ম’ নামের বইটিতে জাতীয় চার নেতার অন্যতম ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, মোহাম্মদ নাসিম ও তাঁর সন্তান তানভীর শাকিল জয়ের সংসদের ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছে।