রামু সহিংসতার আট বছর : থমকে রয়েছে বিচার প্রক্রিয়া
কক্সবাজারের রামু উপজেলার বৌদ্ধবিহার ও বসতিতে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার আট বছর পূর্ণ হলো আজ। ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর আজকের দিনে রামু, ৩০ সেপ্টেম্বর উখিয়া ও টেকনাফের বৌদ্ধবিহার ও বৌদ্ধপল্লিতে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে ১৯টি বৌদ্ধবিহার, ৪১টি বসতঘর পুড়িয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয় আরো ছয়টি বৌদ্ধবিহারসহ অর্ধশত বসতঘরে। এতে কয়েকশ বছরের প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পুড়ে যায়।
নারকীয় এ হামলার ঘটনায় মামলা করা হলেও আট বছরেও শেষ হয়নি বিচার প্রক্রিয়া। সাক্ষীর অভাবে এ বিচার প্রক্রিয়া থমকে থাকলেও বৌদ্ধদের মধ্যে ফিরেছে সম্প্রীতি, পোড়া মন্দিরে তৈরি হয়েছে নান্দনিক স্থাপনা, দৃষ্টিনন্দন স্থাপনাশৈলীতে পুণ্যার্থীদের পাশাপাশি বেড়েছে পর্যটক; ক্ষতিগ্রস্তরা পেয়েছেন নতুন ঘর।
এদিকে, এখনো বিভিন্ন বিহারের নিরাপত্তায় সতর্ক রয়েছে পুলিশ বাহিনী। এ ছাড়া সেনাবাহিনীসহ স্থানীয় প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা সার্বক্ষণিক নজরদারি রেখেছেন সব বৌদ্ধবিহারে। পূজা-পার্বণ, ধর্মীয় উৎসবে অন্য ধর্মাবলম্বীদের সরব উপস্থিতিতে এখন মুখর হয় বিহার প্রাঙ্গণ। তবে বিচার প্রক্রিয়ার অচলাবস্থা নিয়ে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে রয়েছে অসন্তোষ। অপরাধীরা আইনের আওতায় না আসায় তাদের শঙ্কা কাটছে না।
আজকের দিনের নারকীয় হামলার ঘটনা স্মরণ করে রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহারের উপাধ্যক্ষ শীলপ্রিয় থের বলেন, ‘ঘটনাটি স্মরণ করলে এখনো চোখ দিয়ে জল বের হয়। কঠিন সময় গেছে আমাদের। দুর্বৃত্তরা আমাদের বৌদ্ধবিহার ও বৌদ্ধপল্লি পুড়িয়ে দিয়ে অনেক ক্ষতি করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ত্বরিত সিদ্ধান্তে ওই সময়ে আমাদের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মাধ্যমে পুনর্নির্মাণ করা হয় বৌদ্ধবিহারগুলো। এ জন্য আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আট বছর হয়ে গেছে, ওই দিন থেকে আজও কয়েকটি বিহারে নিরাপত্তা দিয়ে যাচ্ছে প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনী।’
শীলপ্রিয় আরো বলেন, ‘আমরা হারিয়ে যাওয়া দিনের চেয়ে বর্তমানে অনেক সম্প্রীতি ভোগ করছি। এখন আমাদের সম্প্রীতি অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা রামুবাসী সম্প্রীতিতে আছি। আগামী দিনেও আমাদের এ সম্প্রীতি ধরে রাখতে হবে।’
রামুর সহিংসতার ঘটনায় আজ সংঘদান ও শান্তিপূর্ণ মানববন্ধন আয়োজন করেছে রামু কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ যুব পরিষদ। লাল চিং ও মৈত্রী বিহার প্রাঙ্গণে দিনব্যাপী এ কর্মসূচি পালিত হবে। রামু পানের ছড়া বৌদ্ধবিহারের অধ্যক্ষ সুচারিতা মহাথের এ অনুষ্ঠানের সভাপতি ও পুণ্যাচার ভিক্ষু সংসদের সাধারণ সম্পাদক, চট্টগ্রামের পটিয়া কেন্দ্রীয় বৌদ্ধবিহারের অধ্যক্ষ ড. সংঘপ্রিয় মহাথের প্রধান আলোচক হিসেবে ধর্মালোচনা করবেন।
ভোরে বুদ্ধপূজা, সকালে জাতীয় ও ধর্মীয় পতাকা উত্তোলন, অষ্ট পরিষ্কার দানসহ মহাসংঘদান, দুপুরে শান্তিপূর্ণ মানববন্ধন, অতিথি ভোজন, বিকেলে হাজার প্রদীপ প্রজ্বালন ও সন্ধ্যায় বিশ্বশান্তি কামনায় সমবেত প্রার্থনার মাধ্যমে ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বরের সাম্প্রদায়িক হামলার বিভীষিকাময় আট বছর স্মরণ করা হবে। রামু কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ যুব পরিষদের আহ্বায়ক বিপুল বড়ুয়া আব্বু এসব আয়োজনের কথা জানিয়েছেন। অনুষ্ঠানে বৌদ্ধভিক্ষুসহ স্থানীয় গ্রামবাসী অংশ নেবেন বলেও জানান তিনি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পবিত্র কোরআন অবমাননা করা হয়েছে এমন একটি খবর ছড়িয়ে পড়লে ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ও ৩০ সেপ্টেম্বর বৌদ্ধমন্দির ও বসতঘরে অগ্নিসংযোগ ও হামলা চালানো হয়। সাম্প্রদায়িক এ হামলায় পুড়ে যায় এসব মন্দিরে থাকা হাজার বছরের প্রত্নতাত্ত্বিক সব নিদর্শন। এ ঘটনার পর দায়ের করা হয় ১৯টি মামলা। এর মধ্যে রামুর আটটি মামলায় ৪৫৮ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। তবে রামু থানার জনৈক সুধাংশু বড়ুয়ার করা মামলাটি দুপক্ষের আপস-মীমাংসার ভিত্তিতে প্রত্যাহার করা হয়।
রামুর সহিংসতার ঘটনা দীর্ঘদিনের সম্প্রীতিতে যে আঘাত হেনেছিল, তা অনেকটা দূর হয়েছে। তবে সম্পূর্ণরূপে আগের জায়গায় ফিরে যাওয়া সময়সাপেক্ষ বলে জানান কক্সবাজার বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু। তিনি বলেন, ‘রামু সহিংসতার আট বছরে ফিরে এসেছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। রামুর বৌদ্ধরা পেয়েছে দৃষ্টিনন্দন বৌদ্ধবিহার। কিন্তু রামুর ঘটনার পর যে মামলাগুলো হয়েছে, সেই মামলার বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা সংশয়।’
জানা গেছে, বৌদ্ধপল্লিতে হামলার ঘটনায় দায়ের করা ১৯ মামলার এজাহারে নাম-ঠিকানা উল্লেখ করাসহ আসামি ছিল ৩৭৫ জন। রামু থানার আট মামলার এজাহারে মোট আসামি সাত হাজার ৮৭৫ জন। এর মধ্যে ১১১ জনের নাম-ঠিকানা থাকলেও পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পেরেছিল মাত্র ৭৪ জনকে। আর সন্দেহভাজনদের মধ্যে আটক করেছিল ১৩২ জনকে। উখিয়া থানার সাত মামলায় পাঁচ হাজার ৬২৪ আসামি থাকলেও গ্রেপ্তার হয়েছিল ১১৬ জন। টেকনাফ থানার দুটি মামলায় ৬৫৩ আসামির মধ্যে গ্রেপ্তার ছিল ৬৩ জন। কক্সবাজার সদর মডেল থানায় দুই মামলায় এক হাজার ৩০ আসামি থাকলেও গ্রেপ্তার ছিল ৯৮ জন। গত আট বছরে ধাপে ধাপে জামিন নিয়ে বেরিয়ে গেছে সবাই।
বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অভিযোগ, ২০১২ সালের ২৯ ও ৩০ সেপ্টেম্বর রামু, উখিয়া ও টেকনাফে বৌদ্ধপল্লিতে চালানো নারকীয় হামলার ১৮ মামলার একটি বিচারও শেষ হয়নি। ন্যক্কারজনক এ ঘটনায় দায়ীরা কেউ শাস্তি পায়নি। ঘটনার পর বিভিন্ন মামলায় ৯৯৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। এ ঘটনায় আটক সবাই এখন জামিনে। অনেকেই বিদেশে পাড়ি দিয়েছে। ঘটনার পরপরই ক্ষতিগ্রস্ত বৌদ্ধবিহার ও ঘরবাড়ি পুনর্নির্মাণ করে দিয়েছে সরকার।
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম জানান, বর্তমানে করোনাভাইরাসের প্রকোপ ও পুরো কক্সবাজার জেলায় পুলিশ বাহিনীতে বদলিজনিত কারণে মামলার সাক্ষ্য গ্রহণে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছে। তবে মামলার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। পুলিশ যদি মামলার সাক্ষীদের আদালতে উপস্থাপন করতে পারে এবং সাক্ষীরা যদি যথাযথ সাক্ষ্যদান করেন, তাহলে প্রকৃত দোষীদের শাস্তি দিয়ে বিচারকার্য সম্পন্ন করা যাবে এবং ঘটনার সত্য উদঘাটন হবে।
রাষ্ট্রপক্ষের এ আইনজীবী আরো জানান, বৌদ্ধবিহার ও বসতিতে হামলার ঘটনায় সর্বমোট ১৯টি মামলা করা হয়। এর মধ্যে বাদীর সম্মতিতে একটি মামলা প্রত্যাহার করা হয়। অন্য ১৮টি মামলা আদালতে বিচার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। সাক্ষীর সহযোগিতায় বিচারকার্য ত্বরান্বিত হবে।
কক্সবাজার বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বলেন, ‘রামুতে ১৮টি মামলার বাদীই পুলিশ। পুলিশ কাকে আসামি করেছে, কাকে বাদ দিয়েছে বৌদ্ধ সম্প্রদায় কিছুই জানে না। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে পুলিশকে বারবার তাগিদ দেওয়া সত্ত্বেও যারা মিছিলের সামনের সারিতে ছিল, যারা ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগে নেতৃত্ব দিয়েছে, এদের অনেকেরই নাম পুলিশের অভিযোগপত্রে নেই।’ রামু সহিংসতার মতো কোনো ঘটনা যাতে বাংলাদেশে আর না ঘটে, এর একটি দৃষ্টান্ত রচিত হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু আরো বলেন, ‘চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার পর আদালতের নির্দেশে গঠিত বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে গঠিত উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি জড়িতদের দ্রুত বিচারের মুখোমুখি করতে সুপারিশ করে। কিন্তু ঘটনার পরিকল্পনাকারী গডফাদারদের কাউকেই গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। উল্টো অনেক নিরপরাধ ব্যক্তিকে আটক করে এসব মামলা দুর্বল করে ফেলা হয়েছে। আবার অনেক সাক্ষীর নাম-ঠিকানাও লেখা হয় ভুলভাবে। তাই আটক সবাই জামিন পেয়ে গেছে আর এখনো অধরা রয়ে গেছে দায়ীরা। সচেতন মহলের মতে, ন্যক্কারজনক এ ঘটনার পরিকল্পনাকারী, গডফাদার বা নেতৃত্বদাতাদের মামলায় অন্তর্ভুক্ত করা হলেই বেরিয়ে আসবে ঘটনার আসল রহস্য।
রামুর ১০০ ফুট ভুবন শান্তি গৌতম বুদ্ধমূর্তির প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক করুণাশ্রী থের বলেন, ‘মধু পূর্ণিমার রাতে রামু, উখিয়ার প্রায় ২০টি বৌদ্ধবিহার পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয় আমাদের ১০০ ফুট বিশ্বশান্তি গৌতম বুদ্ধমূর্তি ও বিমুক্তি বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্র। সংস্কৃতি সমৃদ্ধ প্রত্নতাত্ত্বিক এ নিদর্শনগুলো দেশ-বিদেশের যোগাযোগের সেতুবন্ধন ছিল। শুধু বৌদ্ধদের জন্য নয়, রামুর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমৃদ্ধ বৌদ্ধবিহারগুলো বাংলাদেশের গর্ব ছিল।’
করুণাশ্রী থের আরো বলেন, যারা ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল, তারা হয়তো বুঝতে পারেনি, বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক সংস্কৃতিক নিদর্শনগুলোকে নষ্ট করা হয়েছে। এ ঘটনায় সমগ্র বিশ্ব সোচ্চার হয়, দুঃখ প্রকাশ করে। যদিও এখন দালান হয়েছে, আগের পুরাতন ঐতিহ্য শৈল্পিক নিদর্শন কাঠের বিহারগুলো এখন আর নেই।
বাংলাদেশ ও বিশ্বের সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করে করুণাশ্রী বলেন, ‘কোনো দেশে, কোনো স্থানে, কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে কেউ যেন এ রকম আঘাত না করে। বরং জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে আমরা যেন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো রক্ষা করতে এগিয়ে আসি।’
রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহারের সাধারণ সম্পাদক রাজু বড়ুয়া বলেন, ‘রামু সহিংসতার আট বছর পার করছি আমরা। ঘটনার এ আট বছরে রামুর পরিস্থিতি আগের মতো ভালো। তবে এ ধরনের ঘটনা যাতে আর কোথাও না ঘটে, এ জন্য সবাইকে আরো সতর্ক থাকতে হবে।’ তিনি বৌদ্ধদের পাশে থেকে সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসনসহ সরকার ও রামুবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানান।
এদিকে, যে ব্যক্তির ফেসবুক অ্যাকাউন্টে কোরআন অবমাননাকে কেন্দ্র করে ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর হামলার ঘটনা ঘটে, সেই উত্তম বড়ুয়া কী অবস্থানে আছেন, জানে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বৌদ্ধদের অনেকের প্রশ্ন, নিখোঁজ উত্তম বড়ুয়া আজও বেঁচে আছেন তো? বেঁচে থাকলে পুলিশ এখনো তাঁর হদিস পায়নি কেন? উত্তম কোথায় আছে, সে বিষয়েও নিশ্চিত কোনো তথ্য জানা নেই পুলিশের। অথচ ঘটনার প্রকৃত কারণ জানতে দরকার উত্তমকে। কে, কীভাবে, কে তাঁর ফেসবুকে ওই ছবি ট্যাগ করল, সেটি জানতেও দরকার উত্তম বড়ুয়ার স্বীকারোক্তি। কিন্তু ঘটনার আট বছরেও পুলিশ তাঁর অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে না পারায় ক্ষুব্ধ রামুর সাধারণ মানুষ। রামুতে বৌদ্ধবিহার পোড়ানোর দিন থেকেই খোঁজ পাওয়া যায়নি উত্তম বড়ুয়ার।