রাস্তার আহত-ক্ষুধার্ত কুকুর-বিড়ালের হয়ে কথা বলেন তাঁরা
ঢাকা শহরের অলিতে-গলিতে হাজারও কুকুরের বসবাস। ঘনবসতিপূর্ণ এ শহরে অন্যান্য প্রাণীর দেখা না মিললেও আনাচকানাচে ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে কুকুর, দেখা মেলে বিড়ালেরও। মানুষের আশপাশে ঘুরঘুর করতে থাকা এ দুই প্রাণীর জীবনযাপন দেখলে মনে হয়, তারা যেন মানুষের প্রতিপক্ষ হয়ে বসবাস করছে।
মানুষকে খেতে দেখলে ক্ষুধার্ত কুকুর পাশে দাঁড়ায়, কিছু খেতে চায়। আর দিনদুপুরে, রাতবিরেতে হন্যে হয়ে কুকুরের পাশাপাশি খাবারের খোঁজ করতে থাকে বিড়ালও। সামান্য খাবারের জন্য নিজেরা মারামারিতেও জড়িয়ে পড়ে। এ শহর যেন তাদের জন্য নয়। তাদের জন্য নয় শহরের মানুষ। এর মধ্যে কুকুর নিয়ে মানুষের অভিযোগ রয়েছে অনেক। কুকুরের ভয়ও রয়েছে তাদের মধ্যে। আর এ প্রাণীর সংখ্যা যত বাড়ছে, প্রকট হচ্ছে সমস্যা, বাড়ছে তাদের খাবারের চাহিদাও।
এ সমস্যা থেকে নিস্তার পেতে এবং কুকুরদের জন্য শহরকে বাসযোগ্য করে তুলতে বন্ধ্যত্বকরণ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন কয়েকজন তরুণ-তরুণী। আর এ বিষয়টিকে সামনে রেখে নিজেদের মূল্যবান সময় ও শ্রম বিলিয়ে দিচ্ছেন প্রাণীদের জন্য। এতেই তাঁদের স্বস্তি। মানুষ না হয় চেয়েচিন্তে নিজের খাবার সংগ্রহ করতে পারে। কিন্তু, প্রাণীরা তা পারে না। তাই, এসব প্রাণীর হয়ে কথা বলার কাজটি করছেন তাঁরা। আর, তাঁদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সাজেদা হুসেইন। সঙ্গে রয়েছেন ফারহাদ জামান, ফারহাদ রাকিব, সুমাইয়া খুশবু, কাজি ইশতিয়াক আহমেদ, সাজ্জাদ অনি, আরিয়ানসহ আরও কয়েকজন প্রাণীপ্রেমী মানুষ। তাঁদের প্রত্যেকেরই পরিচয় প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা থেকে। প্রাণীদের জন্য টুকটাক কাজ করতে করতে নিজেরাই নিজেদের খুঁজে নিয়েছেন।
এসব প্রাণিপ্রেমী মানুষ জানান, বর্তমানে নিজেদের উদ্যোগেই ঢাকায় কুকুর বন্ধ্যত্বকরণ ও টিকাকরণের কাজ করছেন তাঁরা। এরই মধ্যে ঢাকার বেশ কয়েকটি জায়গায় এ কাজটি তাঁরা করেছেন। তবে, এ কাজের পাশাপাশি এখন পর্যন্ত অগণিত আহত কুকুর-বিড়াল উদ্ধার আর চিকিৎসার ভার কাঁধে নিয়েছেন এই প্রাণিকল্যাণ কর্মীরা। রাস্তায় চলতে-ফিরতে অথবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বিভিন্ন প্রাণীর গ্রুপ থেকে যখন তাঁরা জানতে পারতেন, কোনো কুকুর-বিড়ালের জীবন সংকটাপন্ন, তখনই নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী ছুটে গেছেন। আর, এ কাজটি করতে দরকার অর্থ। এ অর্থ জোগানের জন্য উপায়ও বের করেছেন তাঁরা। এতে পুরোপুরি না হলেও কিছুটা নির্ভার তাঁরা হতে পেরেছেন বলেই জানিয়েছেন। কিন্তু, এ কাজকে এগিয়ে নিতে দরকার আরও সহায়তা।
এসব কাজের নেতৃত্বদানকারী সাজেদা হুসেইন। কীভাবে শুরু হলো এ কাজ? কীভাবে জন্মাল প্রাণীদের প্রতি ভালোবাসা?
সাজেদা বলেন, “ছোটবেলা থেকেই প্রাণীদের প্রতি আমার ভালোবাসা জন্মায়। ছোটবেলায় বেবিট্যাক্সিতে উঠেছেন কখনও? বেবিট্যাক্সির পেছনে বাঘের বাচ্চা আঁকা থাকতো। আমি আর আমার বোন হলুদ রঙের ওই বাঘের বাচ্চা ধরতে চাইতাম। এ ছাড়া আমরা বাসায় বিড়াল পালতাম, এখনও পালি। কিন্তু, কুকুর নিয়ে কাজ এ করোনাভাইরাস আসার পর থেকে শুরু হয়েছে। এই ধরুন ২০১৯-২০ সাল থেকে। বলা হয় না যে, ‘নেসেসিটি ইজ দ্য মাদার অব ইনভেনশন’। করোনাভাইরাস শুরুর পর থেকে নিজের জীবনের ভয়ের কারণে খুব বেশি মানুষ ঘর থেকে বের হতো না। এ ছাড়া দোকানপাটও ছিল বন্ধ। আগে দোকান থেকে বিস্কুট কিনলে কেউ কেউ পাশে থাকা কুকুরকে বিস্কুট খেতে দিতে পারতো। আর করোনার পর এসব দোকান বন্ধ থাকায় না খেয়ে কুকুরগুলোর জান বের হয়ে যাচ্ছিল।”
সাজেদা বলেন, ‘আমার মা ক্যানসারফেরা পেশেন্ট। মায়ের ওষুধ কেনার জন্য আমাকে ঘর থেকে এমনিতেই বের হতে হতো। এ ছাড়া বাজার-সদাই সব আমিই করতাম। আমি যেহেতু বের হচ্ছিলামই, তাই ওদের খাবারটাও খাওয়াতে শুরু করি। আমার নানা একজন পুলিশ অফিসার ছিলেন। সেজন্য পুলিশে আমাদের অনেক পরিচিত লোকজন আছেন। পুলিশের যে রেশনের চাল থাকে, সেগুলো ভালো চাল এবং অনেক কম দামে পাওয়া যায়। একজন আন্টি আছেন, তাঁর স্বামী পুলিশে চাকরি করেন। ওই আন্টির কাছ থেকে চাল আনা শুরু করলাম। এরপর উত্তরার কসাইবাজারে এক মুরগির দোকানদার খুঁজে বের করেছিলাম, সেখান থেকে কুকুরদের জন্য আস্ত মুরগি নেওয়া শুরু করলাম। বারবার বের হতে যেন না হয়, সেজন্য একবারে ৩০ থেকে ৪০ কেজি করে মুরগি নিতাম। অন্যদিক থেকে রেশনের চাল নিতাম। তখন প্রতিদিন সাতটা কুকুর খাওয়াতাম। এখন আমার আশপাশের এলাকায় ১৭টি কুকুরকে খাওয়াই। করোনার সময়টাতে ক্ষুধাটাই কুকুরগুলোর সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল।’ এ ছাড়া গল্পে গল্পে আসে বিড়ালের কথাও। সাজেদাদের বিল্ডিয়েও বিভিন্ন বিড়াল অনেক আগে থেকেই ঘুরঘুর করে। কারণ, তাদের খাবারের উৎস সাজেদাদের বাসা। সিঁড়িতে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকে তাদের খাবার।
এভাবে খাওয়াতে খাওয়াতে এসব প্রাণীদের আরও কিছু বিষয় লক্ষ্য করেছেন সাজেদা। তিনি বলেন, ‘খাবারের চাহিদার শেষ নেই। কিন্তু, কুকুর তো অসংখ্য। খাবারের জন্য মারামারি, মারামারির জন্য জখম হওয়া। জখমের জন্য ঘা হওয়া, পোকা ধরা…। তখন দেখলাম, খাবারটাই যে শুধু দরকার, তা নয়। প্রাণীদের আর আমাদের চাহিদাগুলো যে একই রকম, এটা তো সাধারণ একটা কথা। কিন্তু, আপনি যদি গভীরভাবে না ভাবেন, তাহলে প্রাণীর প্রতি কোনোরকম চিন্তা-ভাবনা না করেই কিন্তু জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়। এবং বেশির ভাগ মানুষ তাই করছে। এরপর আমি ভাবলাম—শুধু খাওয়ানোই তাদের জন্য যথেষ্ট নয়। আমার নিজেরই তো খাওয়া, চিকিৎসা, বাসস্থানের চাহিদা আছে; তাহলে তাদেরও সেটি মৌলিক চাহিদাই।’
এই যে বন্ধ্যত্বকরণের কাজ করছেন, এই যে প্রাণীদের উদ্ধার করছেন, এই যে তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন অনেক বার, কিন্তু এসবের জন্য তো খরচের প্রয়োজন। আর এ প্রসঙ্গ আসতেই সাজেদা বলেন, ‘দিনশেষে কোনো কিছুই ফ্রি নয়। নিজের পকেট থেকে সবসময় দেওয়া সম্ভব হয় না। আমি ২০২১ সালের জুলাই পর্যন্ত একাই খরচ করতাম। নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী খরচ করতে পারতাম।’
কিন্তু ধীরে ধীরে সময় বদলাতে থাকে। মোড় পালটে যায়। কাঁধে পড়ে যায় আরও কাজ। সাজেদা বলেন, “২০২১-এর জুলাইয়ে ফেসবুকে একটা পোস্ট দেখেছিলাম যে, একটা কুকুর নিজের শরীরকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে এগোচ্ছে। ওই পোস্টে প্রচুর মন্তব্য যে, কেউ যেন কুকুরটিকে উদ্ধার করে চিকিৎসা করান। কেউ কেউ নিজে থেকে চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করতে চান। তো রিদি নামের একজন রয়েছেন, যিনি প্রাণীদের একটি আশ্রয়কেন্দ্র চালান। নারায়ণগঞ্জে কুকুর-বিড়ালদের জন্য উনার একটা আশ্রয়কেন্দ্র আছে। রিদি বললেন, ‘যদি ওই কুকুরটির চিকিৎসার খরচ দেওয়া হয়, তাহলে আমি তাকে আমার আশ্রয়কেন্দ্রে রাখব।’ এরপর যাঁরা যাঁরা ওই পোস্টে খরচ দেওয়ার কথা বলেছিলেন, তাঁদের নিয়ে একটা মেসেঞ্জার গ্রুপ খুললাম। সেখান থেকেই ফান্ডিংয়ের কাজটা শুরু।’
সাজেদা হুসেইন আরও বলেন, ‘এরপর ওই কুকুরটিকে উদ্ধার করা হয়। কিন্তু, আমি যেটা চিন্তা করলাম, সব কিছুর তত্ত্বাবধান করা, যেমন—কুকুরটাকে কে ধরতে যাবে, চিকিৎসার জন্য কোন ভেটের কাছে নিয়ে যাওয়া হবে, কীভাবে শেল্টারে নেওয়া হবে, এ সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া কোনো ব্যাপার না। কিন্তু, এ দায়িত্বটা যে নেবে, এজন্য তেমন কোনো লোক নেই।’
“এর দুই-তিন সপ্তাহ পর ওই গ্রুপ থেকে আরেকটা কাজ কাঁধে আসে। এরপর ওই মেসেঞ্জার গ্রুপে আমি প্রস্তাব দিলাম, এ ধরনের কাজ যদি আসে, তাহলে কি সবাই অর্থের যোগান দিতে রাজি? গ্রুপ মেম্বাররা আমাকে বললেন, ‘আপনি যদি তত্ত্বাবধান করেন, তাহলে আমরা রাজি।’ যেহেতু তত্ত্বাবধানের জন্য আমি একা ছিলাম, সেহেতু আমি আমার সুবিধা হয়—এমন কাজগুলো করতে শুরু করি। আস্তে আস্তে মানুষ জানল যে, আমি এ কাজ করি। এরপর ফেসবুকে কোনো আহত প্রাণী দেখলে আমাকেসহ আরও কয়েক জন রেসকিউয়ারকে ট্যাগ দেওয়া শুরু করে অনেকে। পরে দেখলাম, এই কয়েকটা মানুষের ওপর অনেক চাপ পড়ে যাচ্ছে। মেসেঞ্জার গ্রুপে ছিলাম মাত্র ১৬ জন। পরে আমিসহ আমার গ্রুপ মেম্বার সামনুম সিদ্ধান্ত নিলাম, আমরা ফেসবুকে একটা পোস্ট দেই যে, মাসে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিতে হবে কুকুর-বিড়ালদের চিকিৎসার জন্য। যারা রাজি, তারা যেন যোগাযোগ করেন। ওই একটা পোস্টের পর এক মাসেই ৭০ হাজার টাকা এসেছিল। বেশির ভাগ মানুষই মাসের পরিবর্তে সারা বছরের টাকা অ্যাডভান্স পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর ওই গ্রুপে ১৬ জন থেকে ৮০ জন মেম্বার হয়ে গেল। এরপর সবাই মাসে ২০০ টাকা করে দিতে শুরু করে। ফলে কাজটা সহজ হতে শুরু করল।’
কুকুরদের উদ্ধারকাজ, চিকিৎসার কাজ আর খাবারের কাজ করতে করতে সাজেদা লক্ষ্য করলেন, এসব কাজই শেষ কাজ নয়। এসব কুকুরের সমস্যা কখনোই যাবে না, কারণ তাদের ভালোবাসে এমন মানুষ কম, তাদের খাবার কম, তাদের থাকার জায়গা কম, চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। কিন্তু, তাদের সংখ্যা প্রচুর। আর এ সংখ্যা দিনকে দিন বেড়েই যাচ্ছে। এর সমাধান কী?
সাজেদা বলেন, ‘একটা বালতির তলায় ফুটো থাকলে, যতই পানি ভরি না কেন, তা কখনোই পূরণ হবে না। এরপর আমি সিদ্ধান্ত নিলাম—কুকুরদের চিকিৎসা তো করাবই, সেইসঙ্গে বন্ধ্যত্বকরণ কার্যক্রম চলবে। এরই মধ্যে প্রায় ২০০ কুকুর বন্ধ্যত্বকরণের কাজ করা হয়েছে। এর মধ্যে উত্তরা ৪, ৬ ও ১০ নম্বর সেক্টর, মিরপুর ১৪, কাজীপাড়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, জিগাতলা, বসুন্ধরাসহ আরও কয়েকটি এলাকায় কাজ হয়েছে। এ নিয়ে ১২টির বেশি বন্ধ্যত্বকরণ কার্যক্রম করা হয়েছে।’
‘গ্রুপ থেকে টাকা তোলা ছাড়াও আমরা যেসব এলাকায় যাই, ওইসব এলাকার বাসিন্দাদের কেউ কেউ অর্থ দিয়ে সহায়তা করেন। এর মধ্যে বসুন্ধরায় তিনটি কাজ করা হয়েছে, কারণ ওই এলাকায় মানুষদের কাছ থেকে বেশি অর্থ পাওয়া গেছে,’ যোগ করেন সাজেদা।
অর্থের পাশাপাশি সময়টাও তাঁদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এ কাজ ছাড়াও নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করাসহ অন্যান্য কাজও রয়েছে তাঁদের। সাজেদা বলেন, ‘এজন্য আমরা কাজগুলো ভাগ করে দেই। রাকিব নামের আমার অনেক কাছের একজন বন্ধু রয়েছে, সে এই প্রজেক্টের কো-ফাউন্ডার। অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের কাজগুলো আমি, রাকিব আর ফারহাদ করি। এ ছাড়া রেসকিউসহ অন্যান্য কাজগুলো আমি, ফারহাদ জামান, ফারহাদ রাকিব, সুমাইয়া খুশবু, কাজি ইশতিয়াক আহমেদ, সাজ্জাদ অনি, আরিয়ানসহ আরও কয়েকজন কর।’
অনেকে মনে করেন, বন্ধ্যত্বকরণের কাজ করলে কুকুর বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। এ প্রসঙ্গে সাজেদা বলেন, ‘আমরা কুকুর বিলুপ্ত করার চিন্তায় নেই। আমরা স্বাস্থ্যবান কুকুরকে বেশির ভাগ সময় বন্ধ্যত্বকরণের আওতায় আনি না। আমাদের কাজ হলো কুকুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা, বিলুপ্ত করা নয়। কুকুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে এলে আমাদের এ কাজও করতে হতো না।’
কুকুর বন্ধ্যত্বকরণের এ প্রজেক্টের সঙ্গে রয়েছেন ফারহাদ জামান। প্রাণীদের জন্য টুকটাক কাজ করতে করতে পরিচয় হয় সাজেদার সঙ্গে। সেই থেকে একসঙ্গে কাজ করা। কীভাবে কুকুর-বিড়ালের প্রতি মানুষের বিরুদ্ধ-মনোভাব কমানো যায়—এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো সচেতনতা বৃদ্ধি করা। প্রাণীদের যে প্রাণ আছে, এটাই আমরা চিন্তা করতে পারি না। মানুষের জন্য আমাদের মায়া লাগবে স্বাভাবিক। কিন্তু, রাস্তায় একটা কুকুর শুয়ে থাকলে আমরা কী করি, লাথি দিয়ে সরিয়ে দেই। ওদের একমাত্র ব্যর্থতা হলো—তারা মানুষের মতো কথা বলতে পারে না। শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাণীদের জন্য এ বিষয়গুলো তুলে ধরা দরকার। এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে দরকার ক্যাম্পেইন।’
প্রাণিরক্ষায় সাজেদা-ফারহাদসহ অন্যদের পাশাপাশি কাজ করেন সুমাইয়া খুশবু। কাজ করতে করতে যুক্ত হন প্রাণিপ্রেমী এসব মানুষের সঙ্গে। খুশবু বলেন, ‘আমাদের অ্যাডমিশন টেস্টের কাজ চলছিল। আমি ইউসিসিতে কোচিং করতাম। কোচিং থেকে ফেরার পথে নিউমার্কেট এলাকায় দেখলাম, একটা প্যারালাইজড মা-কুকুর পড়ে ছিল। কিন্তু, কীভাবে কী করা যাবে, সেসব ব্যাপারে আমার কোনো জ্ঞান ছিল না। এরপর ওই কুকুরটার চিকিৎসা করাই। চিকিৎসা শেষে ওকে আবার নিউমার্কেট এলাকায় ছেড়ে দেই। ওই অবস্থায় ছেড়ে দেওয়ার পর রিকশায় করে অর্ধেক রাস্তা আসার সঙ্গে সঙ্গে আবার রিকশা ঘুরাই। কুকুরটিকে আবার তুলে নিই। কোনোভাবে তার চিকিৎসা করানোর পর সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত কোথায় রাখা যাবে, তা নিয়ে ভাবতে থাকি। আমাদের বাড়িওয়ালার সঙ্গে কথা বলে একটা ব্যবস্থা করলাম। কিন্তু, বেশি সময় তো আর রাখা যাচ্ছে না। এ ছাড়া চিকিৎসার আরও কিছু খরচ রয়েছে। আর আমি একজন শিক্ষার্থী। আমার পক্ষে ব্যয়ভার বহন করা সম্ভব ছিল না। আমার কাছে, আমার ভাই ও বোনের কাছে কিছু টাকা জমানো ছিল। সেখান থেকে টাকা নিয়ে আমি কুকুরটার চিকিৎসার জন্য ইনজেকশন কিনি। কিন্তু, কীভাবে ইনজেকশন প্রয়োগ করা যায়, তা জানতাম না। তাহমিদ নামের এক ভাই ইনজেকশন দেওয়ার কাজে সহায়তা করেছিলেন। চিকিৎসার পর ক্যামেলিয়া নামের এক আপুর প্রাণীদের আশ্রয়কেন্দ্রে কুকুরটাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আমার যত জমানো টাকা ছিল, সেগুলো দিয়ে আমি ওকে গাজীপুরের ওই আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠাই।’
‘এ ছাড়া আমার এলাকার কুকুরগুলোর কিছু হলে আমি ফেসবুকে প্রাণীদের গ্রুপে সহায়তা চাইতাম। এভাবেই সাজেদা আপু-ফারহাদ ভাইসহ গ্রুপের বাকিদের সঙ্গে আমার পরিচয়। কুকুর-বিড়ালের কোনো সমস্যা হলে আমি মূলত অর্থের ব্যবস্থার কাজটি করি। এ কাজ করতে করতে আমার মা প্রায় কথা শোনাত যে, আমার পড়াশোনায় মন নেই।’
খুশবু আরও বলেন, ‘কুকুরকে ভালো নাই লাগতে পারে। কিন্তু, যেন ক্ষতি করা না হয়। কুকুরের কোনো সমস্যা হলে কেউ সহায়তা না করলেও যেন কাউকে না কাউকে জানায় যে কুকুরটা বিপদে আছে, এটাই চাওয়া।’
এদিকে, ভবিষ্যত নিয়েও চিন্তা করে রেখেছেন সাজেদা হুসেইন। তিনি বলেন, ‘আমি জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এ কাজ করতে চাই। একটা আশ্রয়কেন্দ্র দিতে চাই। যেসব কুকুরের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, বয়স্ক কুকুর, প্যারালাইজড কুকুর, অসুস্থ কুকুর—ওদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র দিতে চাই। এ ছাড়া একটা চিকিৎসাকেন্দ্র করতে চাই।’
কীভাবে এ কাজ করা সম্ভব—প্রশ্ন করতেই সাজেদা বলেন, ‘এ কাজগুলোর জন্য ইনভেস্টর আছে, কিন্তু জায়গার অভাব রয়েছে। আর আশপাশেই জায়গাটা খুঁজছি। আশ্রয়কেন্দ্রের সঙ্গেই চিকিৎসাকেন্দ্র দেব। মানুষ কুকুর নিয়ে আসবে। চিকিৎসা করানো শেষে সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত আশ্রয়কেন্দ্রে থাকবে।’
রাস্তায় পড়ে থাকা অসহায় কুকুর-বিড়ালদের জন্য এসব প্রাণিপ্রেমী মানুষ আরও কাজ করতে চান। তাঁরা আহ্বান জানিয়েছেন সহায়তার। সরকার, সিটি করপোরেশনের প্রতি কুকুর-বিড়ালদের জন্য কাজ করার আহ্বান তাঁদের। তাঁরা চান—মানুষ যেন কুকুর-বিড়ালদের প্রতি নির্দয় না হয়। এ ছাড়া কুকুর বন্ধ্যত্বকরণের কাজ চলমান রাখার সিদ্ধান্ত তাঁদের। আর, এর মাধ্যমে একসময় কুকুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে এলে রাজধানীসহ সারা দেশের রাস্তায় নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারবে প্রাণীটি। সেইসঙ্গে থাকবে না তাদের প্রতি মানুষের অভিযোগ।