রায়হান হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে উত্তাল সিলেট
সিলেটের বন্দর বাজার ফাঁড়িতে পুলিশি নির্যাতনে রায়হান উদ্দিন আহমদ (৩৩) নিহতের ঘটনার বিচারের দাবিতে মানুষের বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। গত কয়েকদিনের ধারাবাহিকতায় আজ শুক্রবারও দিনভর খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে নগরীতে বিক্ষোভ করেছে প্রতিবাদী মানুষ।
বাদ জুমা নগরীর বিভিন্ন মসজিদ থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে কোর্ট পয়েন্টে জড়ো হয় মুসল্লিরা। পরে সেখানে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেলসহ ইসলামি নেতারা বক্তব্য দেন।
এ ছাড়া উলামা পরিষদ-সিলেট, উলামা মাশায়েখ পরিষদ-সিলেট, ইসলামি ঐক্যজোট ছাড়াও সমমনা দলগুলো রায়হান হত্যাসহ দেশব্যাপী খুন, ধর্ষণ ও অন্যায়ের প্রতিবাদে নগরীতে খণ্ড খণ্ড মিছিল, মানববন্ধন করেছে।
বিভিন্ন সংগঠনের এসব প্রতিবাদ কর্মসূচি পালনকালে মিছিলে মিছিলে উত্তাল হয়ে উঠে বন্দর বাজার ও আশপাশ এলাকা। দল-মত নির্বিশেষে হাজার হাজার প্রতিবাদী জনতা রায়হানের হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে বিচার নিশ্চিত করার দাবি জানায়।
কোর্ট পয়েন্টের সমাবেশে সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ‘অনেক অসৎ কর্মকর্তা নিজের আখের গোছাতে আসেন, মানুষের কাছ থেকে জুলুম করে টাকা নেন তাঁরা। মাত্র কয়েক হাজার টাকার জন্য- যদি সেটা সত্য হয়, তাহলে এই ঘটনা খুবই দুঃখজনক। এই সম্পর্কে কেউ যদি বলেন, তাঁরা অবহিত নন, তাহলে আমি মানতে পারি না।’
‘এই নগরীর সেবক হিসেবে আমি বলব, পুলিশের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান নয়। তবে, যারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার ও আইনের মুখোমুখি করা হোক। সিলেটের এমসি কলেজের ঘটনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পুলিশ আসামিদের গ্রেপ্তার করে জনগণেকে আশ্বস্ত করেছিল। বাংলাদেশের পুলিশ চাইলেই সেটা করতে পারে। তাহলে এসআই আকবর কেন গ্রেপ্তার হচ্ছে না। আকবর ও তার সঙ্গে জড়িতদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করতে হবে’, যোগ করেন মেয়র।
একই সমাবেশে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল বলেন, ‘পুণ্যভূমি সিলেটের যে ভাবমূর্তি ছিল, তা রায়হান হত্যার মধ্য দিয়ে ধাক্কা খেয়েছে। আপনারা জানেন, অপরাধীর কোনো দল নেই। অপরাধীকে কোনো জাতি-ধর্ম-বর্ণ দিয়ে চিহ্নি করা যায় না। অপরাধী অপরাধীই। সেই অপরাধীদের বিচার করতে এই সরকার বদ্ধপরিকর।’
সিলেট নগরীর আখালিয়া এলাকার নেহারিপাড়ার মৃত রফিকুল ইসলামের ছেলে রায়হান উদ্দিন আহমদকে (৩৩) গত শনিবার রাতে বন্দর বাজার ফাঁড়িতে নির্যাতন করে হত্যা করা হয় বলে পুলিশের তদন্তেই বেরিয়ে এসেছে। পরের দিন রোববার সকালে তাঁর লাশ পায় পরিবার। পরে ওই দিন রাতে নিহত রায়হানের স্ত্রী বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন। মামলাটি তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
স্বজনদের অভিযোগ, ১০ হাজার টাকা না পেয়ে রায়হানকে পুলিশ হেফাজতে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আর পুলিশ দাবি করেছে, নগরীর ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাষ্টঘর এলাকায় ছিনতাইয়ের সময় গণপিটুনিতে নিহত হন রায়হান। তবে স্থানীয় কাউন্সিলর বলছেন, যে এলাকায় গণপিটুনির কথা বলা হচ্ছে সেখানকার সিসিটিভি ক্যামেরা ফুটেজে এ ধরনের কোনো কিছু দেখা যায়নি।
এ ঘটনার পর সোমবার ওই ফাঁড়ির দায়িত্বরত কর্মকর্তা এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়া, কনস্টেবল হারুনুর রশিদ, তৌহিদ মিয়া ও টিটু চন্দ্র দাসকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এ ছাড়া প্রত্যাহার করা হয়- সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আশেক এলাহী, এএসআই কুতুব আলী ও কনস্টেবল সজিব হোসেনকে।
থানাতেই রায়হানের মৃত্যু : তদন্ত কমিটি
সিলেট মহানগর পুলিশের (এসএমপি) কোতোয়ালি থানাধীন বন্দর বাজার পুলিশ ফাঁড়িতে তিন ঘণ্টা ১০ মিনিট ৪০ সেকেন্ড অবস্থানকালেই পুলিশি নির্যাতনে মৃত্যু হয় রায়হান উদ্দিন আহমদের। এসএমপি গঠিত তদন্ত কমিটির প্রথম দিনের তদন্তে এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে বলে জানিয়েছেন তদন্ত কমিটির প্রধান উপকমিশনার (ডিসি) আজবাহার আলী শেখ।
শনিবার দিবাগত রাত ২টা ৩৮ মিনিটে নগরীর কাষ্টঘর এলাকা থেকে রায়হানকে বন্দর বাজার পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরা আটক করেন বলে জানান এসএমপির উপকমিশনার আজবাহার আলী শেখ। তিনি জানান, ওই এলাকারও সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ মিলেছে। সেখানে রায়হানকে গণপিটুনি দেওয়ার কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। সিসিটিভির ফুটেজ, পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষী এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণে এটা প্রাথমিকভাবে প্রমাণ হয়েছে, বন্দর বাজার পুলিশ ফাঁড়িতে জখম হয়েছেন রায়হান। পরে তাঁকে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
অতিরিক্ত আঘাতেই রায়হানের মৃত্যু
গতকাল বৃহস্পতিবার রায়হানের মরদেহ কবর থেকে তুলে পুনরায় ময়নাতদন্ত করা হয়। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. শামসুল ইসলাম বলেন, ‘তিন সদস্যের একটি দল রায়হানের মরদেহের পুনরায় ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেছে। প্রাথমিকভাবে আমরা বলেছি, আসলে অতিরিক্ত আঘাতের কারণেই তার মৃত্যু হয়েছে।’
‘এর আগে গত ১১ অক্টোবর প্রথম ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করি। এবং প্রথম ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন আজ আমরা কোতোয়ালি থানায় দাখিল করেছি’, যোগ করেন চিকিৎসক।
মামলা পিবিআইয়ে, ইমিগ্রেশনে নির্দেশনা
রায়হান উদ্দিন আহমদের মৃত্যুর ঘটনা তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে পিবিআইয়ের প্রধান, উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) বনজ কুমার মজুমদার বলেছেন, ‘প্রাথমিক তদন্তে আমাদের মনে হয়েছে, সিলেট কোতোয়ালি থানার বন্দর বাজার ফাঁড়ির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) আকবর হোসেন ভূঁইয়াকে আমাদের দরকার। সেজন্য আমরা সমগ্র ইমিগ্রেশনে জানিয়ে দিয়েছি, যাতে তিনি পাসপোর্ট নিয়ে পালাতে না পারেন।’
পলাতক এসআই আকবর
সিলেট মহানগর পুলিশের (এসএমপি) কোতোয়ালি থানাধীন বন্দর বাজার পুলিশ ফাঁড়ির প্রধান উপপরিদর্শক (এসআই) আকবর হোসেন ভুঁইয়া হঠাৎ করেই পুলিশের নজরদারির বাইরে চলে গেছেন। তাঁর কোনো খোঁজ পাচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এসআই আকবর যাতে পালিয়ে ভারতে চলে যেতে না পারেন- এজন্য সিলেট জেলার সীমান্তবর্তী সব থানা এলাকায় সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
পুলিশ বলছে, গত সোমবার রাত ১১টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত এসআই আকবর পুলিশের নজরদারিতে ছিলেন। তখন তিনি নগরীর জিন্দা বাজার এলাকায় অবস্থান করছিলেন। এরপর থেকে তাঁর মোবাইল ফোন বন্ধ এবং ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ডি-অ্যাকটিভ দেখাচ্ছে। তাঁর অবস্থান চিহ্নিত করা যাচ্ছে না।
‘ফাঁড়িতে টাকা নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলেন রায়হান’
আলোচিত এই মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, প্রতিদিনের মতো গত শনিবার বিকেল ৩টায় রায়হান উদ্দিন আহমদ কর্মস্থল নগরীর স্টেডিয়াম মার্কেটে ডা. গোলাম কিবরিয়া ও ডা. শান্তা রানীর চেম্বারে যান। রাত ১০টার পর রায়হান বাসায় না ফেরায় তাঁর মোবাইলে ফোন দেওয়া হয়। তখন তাঁর ফোন বন্ধ পায় পরিবার। ভোর সোয়া ৪টার দিকে অন্য একটি নম্বর থেকে রায়হান তাঁর মায়ের কাছে ফোন দেন। তখন রায়হান জানান, তিনি বন্দর বাজার পুলিশ ফাঁড়িতে আছেন। তাঁকে বাঁচাতে দ্রুত টাকা নিয়ে ফাঁড়িতে যেতে বলেন তিনি।
রায়হানের চাচা হাবিবুল্লাহ ভোর সাড়ে ৫টার দিকে বন্দর বাজার পুলিশ ফাঁড়িতে যান। তখন একজন পুলিশ সদস্য বলেন, রায়হান ঘুমিয়ে গেছে। আর যে পুলিশ সদস্য রায়হানকে ধরে নিয়ে এসেছেন, তিনিও বাসায় চলে গেছেন। ওই পুলিশ সদস্য রায়হানের চাচাকে ১০ হাজার টাকা নিয়ে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ফাঁড়িতে আসার কথা বলেন বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে আরো বলা হয়, ‘পুলিশের কথামতো হাবিবুল্লাহ আবার সকাল পৌনে ১০টার দিকে ফাঁড়িতে যান। তখন দায়িত্বরত পুলিশ তাঁকে জানান, রায়হান অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁকে ওসমানী মেডিকেলে ভর্তি করা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে রায়হানের চাচা ওসমানী হাসপাতালে গিয়ে জরুরি বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, রায়হানকে সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে তিনি মারা গেছেন। এ সময় হাবিবুল্লাহ পরিবারের অন্য সদস্য ও আত্মীয়স্বজনকে খবর দিলে তাঁরা গিয়ে ওসমানী মেডিকেলের মর্গে রায়হানের ক্ষতবিক্ষত লাশ দেখতে পান।
এজাহারে বাদী উল্লেখ করেন, ‘আমার স্বামীকে কে বা কারা বন্দর বাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে গিয়ে পুলিশি হেফাজতে রেখে হাত-পায়ে আঘাত করে এবং হাতের নখ উপড়ে ফেলে। পুলিশ ফাঁড়িতে রাতভর নির্যাতনের ফলে আমার স্বামী মারা গেছেন।’