রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অগ্নিকাণ্ডের তদন্ত দাবি বিএনপির
কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও দলটির বৈদেশিক যোগাযোগ কমিটির (এফআরসি) চেয়ারম্যান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী।
আজ মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এই অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ১০ হাজার ঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এ পর্যন্ত ১১ জনের অগ্নিদগ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। দেড় শতাধিক শিশুসহ অসংখ্য নারী, পুরুষ ও শিশু নিখোঁজ রয়েছে। হাজার-হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী বাড়ি-ঘর, আসবাবপত্র হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে অত্যন্ত মানবেতর অবস্থায় দিনযাপন করছে।
বিবৃতিতে বিএনপি মহাসচিব রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের আত্মার মাগফেরাত কামনা এবং ক্ষতিগ্রস্ত ও আহতদের প্রতি সমবেদনা জানান। তিনি সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতি তাদের পুনর্বাসন ও সহযোগিতায় এগিয়ে আসারও আহ্বান জানান। তিনি অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে দ্রুত তদন্ত করার এবং তদন্ত প্রতিবেদন জনসম্মুখে প্রকাশ করারও দাবি জানান।
বিবৃতিতে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মিয়ানমারে হত্যা-নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়ে প্রায় সাড়ে তিন বছর আগে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গা নারী-পুরুষকে তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে এখন পর্যন্ত কার্যকর ও দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় সরকারের সমালোচনা করেন এবং এ বিষয়ে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান।
এদিকে বিএনপির বৈদেশিক যোগাযোগ কমিটির (এফআরসি) চেয়ারম্যান ও স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অগ্নিকাণ্ডে যথাযথ তদন্ত দাবি করে গণমাধ্যমে প্রকাশের জন্য একটি বিবৃতি দিয়েছেন। বিবৃতিতে তিনি ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার প্রতি মানবিক কারণে তাদের পাশে এসে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। তাৎক্ষণিকভাবে যেসব স্বেচ্ছাসেবক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে এনেছেন এই বিবৃতিতে তিনি তাদের অভিনন্দন জানিয়েছেন।
বিবৃতিতে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী আরও বলেন, ১১ লাখ রোহিঙ্গা সম্প্রদায় মিয়ানমারের বৈধ নাগরিক। জোর করে তাদের নিজ বাসভূমি থেকে উচ্ছেদ করে বাংলাদেশে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে যা একটি ক্ষুদ্র জাতি সত্ত্বাকে নির্মূল করার চরম বহিঃপ্রকাশ। বাংলাদেশ মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দিলেও মিয়ানমারের নাগরিক অধিকারসহ রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করতে মিয়ানমারকে বাধ্য করাই এই সমস্যার সমাধান। সংশ্লিষ্ট সব পক্ষসহ আন্তর্জাতিক মহল কর্তৃক রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে মিয়ানমারের ওপর সম্মিলিত চাপ প্রয়োগ করার জন্য তিনি আহ্বান জানান।
কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয়ের অতিরিক্ত কমিশনার শামসুদ দৌজা জানান, গতকাল সোমবার বিকেল ৪টার দিকে উখিয়ার বালুখালী আট নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। মুহূর্তের মধ্যে আগুন পাশের অন্য ক্যাম্পগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। সন্ধ্যার আগেই আগুন একে একে আট নম্বর, ওয়েস্ট আট, নয়, ১০ ও সর্বশেষ ১১ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ছড়িয়ে যায়। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের কক্সবাজার, উখিয়া, রামু ও টেকনাফ থেকে সাতটি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা চালায়। এ সময় সেনাবাহিনী, পুলিশ, এপিবিএনের সদস্য, রেডক্রিসেন্টের টিম ও স্থানীয় গ্রামবাসী যোগ দেন। পরে গতকাল রাত সাড়ে ৯টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
শামসুদ দৌজা আরও জানান, আগুনে রোহিঙ্গাদের ১০ হাজারে বেশি ঘর পুড়ে গেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হলেও এই সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। এ ছাড়া, পুড়ে গেছে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন এনজিও অফিস ও পুলিশ ব্যারাক।
অগ্নিকাণ্ডে রোহিঙ্গা ক্যাম্প লাগোয়া বাংলাদেশি বাসিন্দাদের দুই শতাধিক বাড়িঘর পুড়ে গেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী।
উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আহমদ নিজাম উদ্দিন জানিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, অন্তত ১০ থেকে ১৫ হাজার রোহিঙ্গা পরিবারের ৪০ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা এখন অনেকটা গৃহহীন। একইভাবে দুই শতাধিক বাংলাদেশি পরিবারের বসতবাড়ি পুড়ে গেছে।
উখিয়ার বালুখালী আট নম্বর এপিবিএনের অধিনায়ক (পুলিশ সুপার) মো. শিহাব কায়ছার জানিয়েছেন, ‘আগুনে বালুখালীতে অবস্থানরত চার নম্বর এপিবিএনের ব্যারাক আংশিক পুড়ে গেছে। তবে অস্ত্র ও মূল্যবান আসবাবপত্র নিরাপদে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। আগুনে রোহিঙ্গাদের ঝুপড়ি ঘর ছাড়াও বেশকিছু এনজিও অফিস, স্কুল-মাদ্রাসা পুড়ে গেছে।’
জাতিসংঘের অভিবাসনবিষয়ক সংস্থা আইওএমের নেতৃত্বাধীন ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপের (আইএসসিজি) কর্মকর্তা সৈয়দ মোহাম্মদ তাফহিম বলেন, ‘কুতুপালং বালুখালী এলাকার রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন সরকারি ও মানবিক সহায়তা প্রদানকারী সংস্থাগুলো একসঙ্গে কাজ করেছে। কিন্তু এখনই সামগ্রিক ক্ষয়ক্ষতির উপর বিস্তারিত তথ্য দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে আমরা দেখতে পাচ্ছি এর তীব্রতা অনেক। হতাহতের এবং ক্ষয়ক্ষতির খবর যাচাই করা হচ্ছে।’
সৈয়দ মোহাম্মদ তাফহিম জানান, ক্যাম্পভিত্তিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য তৈরি একটি শিটের হিসাব অনুযায়ী বালুখালীর ৮-ই ক্যাম্পে ঘরের সংখ্যা ছয় হাজার ২৫০, আর লোক সংখ্যা ২৯ হাজার ৪৭২ জন, ৮-ডব্লিউ ক্যাম্পে বাড়ি ছয় হাজার ৬১৩টি, আর লোক সংখ্যা ৩০ হাজার ৭৪৩ জন, ক্যাম্প ৯-এ ক্যাম্পে বাড়ি সাত হাজার ২০০টি, লোকসংখ্যা ৩২ হাজার ৯৬৩ জন এবং ১০-এ ক্যাম্পে বাড়ি ছয় হাজার ৩২০টি, আর লোকসংখ্যা ২৯ হাজার ৭০৯ জন।
আইএসসিজির এই কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, অগ্নিকাণ্ডে এই চারটি ক্যাম্পের অধিকাংশ ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এটিই সবচেয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড।
উখিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) গাজী সালাউদ্দিন জানিয়েছেন, আগুনের সূত্রপাত নিয়ে এখনো তেমন বিশ্বাসযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়নি। ঘটনাস্থলে গিয়ে রোহিঙ্গাদের কাছে জানতে চাইলে তারাও নানা তথ্য দিয়ে আসছে। এমনকি রোহিঙ্গারাই একে-অপরের বিরুদ্ধে দোষারোপ করে আসছে। তদন্ত শেষে আসল ঘটনা বেরিয়ে আসবে।
এদিকে, দীর্ঘ সাত ঘণ্টার অগ্নিকাণ্ডে হাজার হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয়স্থল হারিয়ে এক কাপড়ে আশ্রয় নিয়েছে কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কে। আশ্রয়হারা লোকজন হারিয়েছে তাদের ক্যাম্পের ঝুপড়ি ঘরের সব মালামাল। আশপাশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় গ্রামবাসীর বসতভিটায় আশ্রয় নিয়েছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা।