লকডাউনে বইমেলা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া

Looks like you've blocked notifications!
অমর একুশে গ্রন্থমেলা। ফাইল ছবি

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এতটাই ভয়াবহ হয়ে উঠেছে যে, সরকার সারা দেশে নাগরিকদের ঘরে থাকার নির্দেশনা দিয়ে লকডাউনের মতো কঠোর পদক্ষেপের ঘোষণা দিয়েছে। এই লকডাউন আগামীকাল সোমবার থেকে কার্যকর হবে। সরকার বলছে, আদেশ আমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

ঠিক এমন এক প্রেক্ষাপটে, বইমেলার লেখক-প্রকাশকরা আশায় থাকবেন; পাঠক মেলায় বই কিনতে আসবেন। কারণ, লকডাউনের মধ্যেও চলবে বইমেলা। বাড়ানো হয়েছে মেলার সময়ও। এখন থেকে প্রতিদিন দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত মেলা চলবে বলে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়। যদিও সাধারণ মানুষের পাশাপাশি কোনো কোনো লেখকও বইমেলা বন্ধের পক্ষে মত দিয়েছেন।

আজ রোববার দুপুরে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব জেসমিন নাহার স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাস সংক্রমণের বিদ্যমান পরিস্থিতি ও সরকার কর্তৃক লকডাউন নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত প্রতিদিন দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত বইমেলা চলবে।

একইভাবে স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে চলা ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ যেকোনো কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার জন্যও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে প্রজ্ঞাপনে।

এর কিছু আগেই আগামীকাল সোমবার থেকে এক সপ্তাহের জন্য লকডাউন ঘোষণা করে ১১ দফা সম্বলিত প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। প্রজ্ঞাপনে লকডাউনের মধ্যে সারা দেশে গণপরিবহণ বন্ধ, জরুরি প্রয়োজন ছাড়া সন্ধ্যা ৬টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত ঘরের বাইরে বের হওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করার কথা বলা হয়েছে।

এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিকেলে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমরা চাইনি বইমেলা এভাবে হোক। আমরা চেয়েছিলাম, বইমেলা অনলাইনে হোক। এই কথা গত ১ ফেব্রুয়ারি জানিয়েছিলাম। কিন্তু তখন সাংবাদিক ও প্রকাশকরা তা মানতে চাননি। তাঁরা বলেছিলেন, শারীরিকভাবে বইমেলা না হলে তাতে প্রাণ থাকবে না। সেজন্য বইমেলা চলছে।’

‘আমার বাংলা একাডেমির অনেকেই করোনায় আক্রান্ত। আমি কীভাবে চাইব বইমেলা চলুক? বইমেলা খোলা রাখার এ সিদ্ধান্ত ভালো হলে ভালো লিখবেন, না হলে খারাপ লিখবেন’, যোগ করেন কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী।

তবে এই অবস্থা নিয়ে রসিকতাই করেছেন সাগর আহমেদ নামে একজন পাঠক। তিনি বলেন, ‘একদিকে বাস কিংবা অন্য যানবহন চলবে না বলে ঘোষণা দেওয়া হলো, অন্যদিকে আমাকে বলা হলো লকডাউনেও বইমেলা খোলা থাকবে। আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বলা হলো, আসতে হবে না! এই হচ্ছে অবস্থা।’

এবার বইমেলায় সুবর্ণ আদিত্যের ‘গন্ধচুরি ও হাওয়ার নিরঙ্গম’ নামে একটি কবিতার বই এসেছে। তরুণ এই কবি বলেন, ‘লকডাউনের মধ্যে বইমেলা চালু রাখার সিদ্ধান্ত অবিবেচনাপ্রসূত। একই স্থানে কিছু শিথিল করবেন, কিছু বন্ধ করবেন, তা তো হয় না। বিষয়টি এমন, জানালা খুলে রেখে এসি চালু রাখা। গাড়ি চলবে না, আবার পাঠককে বলবেন মেলায় যেতে। এটা তো হতে পারে না।’

প্রিন্ট পোয়েন্টি নামে প্রকাশনা সংস্থার কর্ণধার যুবা রহমান বলেন, ‘আমি আসলে এটার পক্ষে নই। লকডাউন করে দিয়ে বইমেলা চালাবেন, সেটা কীভাবে সম্ভব? তবে অন্য প্রকাশকরা হয়তো চেয়েছেন বইমেলা চলুক। আমার মনে হয়, এতে লোকজন হাসাহাসি করবে। প্রকাশকরা তো ক্ষতিপূরণ পাবে না। তখন হয়তো বাংলা একাডেমি বলবে, মেলা তো চলেছেই।’

সাংবাদিক ও প্রকাশকদের কারণে এবার করোনার মধ্যেও বইমেলা চালু রাখতে হয়েছে, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের এমন মন্তব্যের ব্যাপারে জানতে চাইলে জনান্তিকের প্রকাশক সাম্য বলেন, ‘জরুরিসেবা ব্যতীত যেকোনো চলাচল বন্ধ করা হয়েছে, কী কারণে বইমেলা চালু রাখতে হয়েছে আমার বোধগম্য নয়। মহাপরিচালক বলেছিলেন, অনলাইনে বইমেলার ব্যাপারে। কিন্তু সেটার জন্য অন্তত দুই বছরের প্রস্তুতির দরকার। একটি ওয়েবসাইট তৈরি করতে হবে। আরও কত শত কাজ। ১ ফেব্রুয়ারি বললে কীভাবে হবে? গাড়ি-ঘোড়া সব বন্ধ। মানুষ মেলায় আসবে কীভাবে? তা ছাড়া আমার প্রশ্ন, ফেব্রুয়ারির বইমেলা কেন মার্চে নিয়ে আসা হলো? ফেব্রুয়ারি হলেও প্রকাশক-লেখকরা কিছুটা হলেও লাভবান হতো। এখন আমি আমার কর্মচারীকে মেলায় পাঠাব কীভাবে? আর প্রকাশক-সাংবাদিকদের চাপে বইমেলা হচ্ছে, এমনটা বলা হলে সেটা যথাযথ বক্তব্য হয়নি।’

বেহুলা বাংলা প্রকাশনীর একজন বিক্রেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘লকডাউনে এমনিতেই লোক আসবে না। আমরা তো ভেবেছিলাম, আজ রোববারই মেলা শেষ হয়ে যাবে। সেটার জন্য মানসিকভাবে আমরা প্রস্তুতও ছিলাম।’

আরেকটি প্রকাশনী সংস্থার একজন বিক্রেতা বলেন, ‘যেহেতু বইমেলা চলবে, আমরা চাইব ক্রেতা আসুক। বই কিনুক। কারণ, আমরা তো বই বিক্রি করতেই মেলায় বসব।’

করোনার কারণে এ বছর বইমেলা নির্দিষ্ট সময় ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয়নি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে এ বছরের ১৮ মার্চ থেকে বইমেলা শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর উদ্বোধন করেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি বাংলা একাডেমিতে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে বইমেলার উদ্বোধন করেন। আগামী ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত এ বইমেলা চলার কথা রয়েছে। শুরুর দিন থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত বইমেলা প্রতিদিন বেলা ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ছয় ঘণ্টার জন্য খোলা ছিল।

পরে বাংলা একাডেমির জনসংযোগ বিভাগের পরিচালক অপরেশ কুমার ব্যানার্জী স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, ‘দেশের ক্রমবর্ধমান করোনা পরিস্থিতিতে অমর একুশে বইমেলা ২০২১-এর সময়সূচিতে আজ ৩১ মার্চ ২০২১ থেকে পরিবর্তন আনা হয়েছে। এখন থেকে বইমেলা শুরু হবে বেলা ৩টায় এবং শেষ হবে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায়।’

আজ আবার সেই সময় পরিবর্তন করে দুপুর ১২টা থেকে সন্ধ্যা ৫টা পর্যন্ত পাঁচ ঘণ্টার জন্য বইমেলা খোলা রাখার সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছে। যদিও গত বৃহস্পতিবার সারা দেশে করোনা সংক্রমণ আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাওয়ায় চলমান বইমেলা বন্ধের সুপারিশ করে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি।

এ বছর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে বইমেলা উৎসর্গ করা হয়েছে। ২০২১ বইমেলার মূল প্রতিপাদ্য হলো ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী’।

করোনা মহামারিতে সামাজিক দূরত্বের কথা মাথায় রেখে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রায় ১৫ লাখ বর্গফুট জায়গায় এবারের বইমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। মোট ৫৪০টি প্রতিষ্ঠানকে ৮৩৪টি ইউনিট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। একাডেমি প্রাঙ্গণে ১০৭টি প্রতিষ্ঠানকে ১৫৪টি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৪৩৩টি প্রতিষ্ঠানকে ৬৮০টি ইউনিট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। মেলায় থাকছে ৩৩টি প্যাভিলিয়ন। এ বছর ‘শিশু প্রহর’ থাকছে না। শিশু কর্নার সোহরাওয়ার্দীতে স্থানান্তর করা হয়েছে।

প্রবেশপথে হাত ধোয়া ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। মাস্ক ছাড়া কাউকে মেলায় ঢুকতে দেওয়া হবে না।