লবণ নিয়ে গুজব : মাঠে প্রশাসন, জরিমানা

Looks like you've blocked notifications!
পিরোজপুরের কাউখালীর বাজারে লবণের জন্য ভিড়। ছবি : ফোকাস বাংলা

সারাদেশে দিনভর গুজব ছড়িয়েছে যে লবণের দাম বেড়েছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, দেশে পর্যাপ্ত লবণ আছে এবং দাম বাড়েনি। তারপরও মানুষ ভিড় করেছে দোকানে। কিনেছে লবণ। দাম বাড়ানো এবং গুজব ছড়ানোর অভিযোগে এরইমধ্যে একাধিক এলাকায় একাধিক ব্যক্তিকে শাস্তি ও জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। আজ মঙ্গলবার এসব ঘটনা ঘটে।

আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো প্রতিবেদন-

শিহাব উদ্দিন বিপু, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

দেশের বিভিন্ন জায়গার মত মঙ্গলবার সকাল থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় লবণের দাম বেড়েছে বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। এই তথ্যের ভিত্তিতে বাজার তদারকিতে নামেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।  ভ্রাম্যমাণ আদালত জগৎবাজার, আনন্দবাজারসহ শহরের বিভিন্ন বাজার তদারকি করেন। এ সময় লবণ প্রতিকেজি ৩০ থেকে ৩৫ টাকা এবং পেঁয়াজ ১০০ থেকে ১৬০ টাকার মধ্যে বিক্রি হতে দেখা গেছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা পঙ্কজ বড়ুয়া বলেন, ‘লবণের বৃদ্ধি পাওয়ার খবরে আমরা বাজার মনিটরিং করে এ রকম কিছু পাইনি।’ তিনি জনগণকে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য আহ্বান জানান। এ সময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) এস, এম মশিউজ্জামান, ক্যাব  ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাধারণ সম্পাদক এস.এম শাহিন প্রমুখ।   

আবু হোসেন সুমন, মোংলা

দাম বৃদ্ধির গুজবে মোংলায় চলছে লবণ বেচাকেনার ধুম। লবণ কিনতে মঙ্গলবার বিকেল থেকে পৌর শহরের দোকানপাটগুলোতে ছিল উপচে পড়া ভিড়। অভিযোগ উঠে ক্রেতাদের ভিড় থাকায় দোকানিরা বেশি দামে বিক্রি করছেন লবণ। নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষদেরই বেশি দেখা গেছে লবণ কিনতে। ক্রেতারা জানান, পেঁয়াজের মতো লবণের দাম বৃদ্ধির খবর শুনেই তারা আগে ভাগে লবণ কিনে রাখছেন। এই সুযোগে দোকানিরাও দাম বাড়িয়ে নিচ্ছেন। এদিকে লবণের দাম বৃদ্ধির গুজব রোধে বাজার তদারকিতে নেমেছে স্থানীয় প্রশাসন। বিকেলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) নয়ন কুমার রাজবংশী পুলিশ নিয়ে অভিযানে নামেন। এ সময় তিনি দোকানি ও সাধারণ লোকজনকে গুজবে কান না দেওয়ার আহ্বান জানান। এ ছাড়া বেশি দামে লবণ না বিক্রি করার জন্য দোকানিদের সতর্ক করেন তিনি। তবে দোকানিরা জানান, বেশি দামে নয়, আগের দামেই লবণ বিক্রি করছেন তারা। লবণের দাম বৃদ্ধির গুজবে শহরতলীর মিঠাখালী, চাঁদপাই ও দিগরাজসহ আশপাশের বাজার থেকেও বেশি দামে লবণ কিনছেন ক্রেতারা। কেজি প্রতি ১০ থেকে ২০ টাকা করে বেশি দামে এক একজন লবণ কিনছেন ৫/১০ থেকে ২০ কেজি পর্যন্ত। এছাড়া পাইকারি বাজার থেকে লবণ কিনে মজুদ করছেন খুচরা দোকানিরা। শহরের দোকান ও গুদাম এখন অনেকটাই লবণ শূণ্য। বাজারের বড় বড় দোকানগুলোতে দেখা গেছে লবণের তাক ফাঁকা। মুহূর্তের মধ্যেই লবণ বিক্রি করে দোকানের তাক ফাঁকা করে ফেলেছেন দোকানিরা।

গুজবের কান না দেওয়ার জন্য বিকেল থেকে শহর জুড়ে মাইকিং করা হচ্ছে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রাহাত মান্নান বলেন,  ‘গুজব ঠেকাতে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এছাড়া যে সকল দোকানিরা বেশি দামে লবণ বিক্রি করবেন এবং মজুদ করে সংকট সৃষ্টি করবেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

মাহবুব হোসেন সারমাত, গোপালগঞ্জ

দাম বাড়ার গুজবে  গোপালগঞ্জে লবণ কেনার হিড়িক পড়েছে। গোপালগঞ্জ শহরের পাইকারি ও খুচরা দোকানে লাইন দিয়ে খুচরা বিক্রেতা ও ক্রেতাদের লবণ ক্রয় করেছেন হরদমে। দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে মঙ্গলবার বিকেলে বাজার তদারকিতে নামে জেলা প্রশাসন।

এ সুযোগে শহরের অসাধু ব্যবসায়ীরা প্রতিকেজি লবণে ৫ থেকে ১৫ টাকা  বৃদ্ধি করেছে বলে অভিযোগ করেছেন ক্রেতারা। গ্রামে প্রতিকেজি লবণ ৫০ থেকে ৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে বলে জানা গেছে।

সরেজমিনে জানাগেছে, গত সোমবার দিবাগত রাত থেকে কোটালীপাড়া উপজেলায় লবণের কেজি ২শত টাকা হবে এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ে। তারপর এর ঢেউ এসে লাগে  গোপালগঞ্জ বাজারে । মঙ্গলবার দুপুর থেকে লবণ পেতে ক্রেতারা দোকানে দোকানে দোকানে ধরনা দেন। বাজারে লবণ ক্রেতাদের ঢল নামে। প্রত্যেকেই ৫/১০ কেজি করে লবণ কিনেছেন। বিকেলের আগেই শহরের সব দোকানের লবণ শেষ হয়ে যায়। বাজারে আগতদের সবার হাতেই ছিল লবণ আর লবণ।

হঠাৎ করে এভাবে লবণের বেচা কেনা বৃদ্ধিতে লবণের ডিলার, পাইকারি বিত্রেতা  ও খুচরা ব্যবসায়ীরা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।

লবণ ক্রেতা শিবানী রানী জানান, খাবার লবণ ৩৫ টাকার জায়গায় ৫০ টাকা কেজি দরে ৩ কেজি ক্রয় করেছি। গোপালগঞ্জ শহরের নতুন বাজার রোডের লবণের ডিলার সরদার ট্রের্ডাসের সত্ত্বাধিকারী নজরুল সরদার বলেন, ‘সকালে কোটালীপাড়া থেকে লবণ নিতে আসে ক্রেতারা।’ সারা দিনে তিনি ৩০ টন লবণ বিক্রি করেছেন বলে জানান। তবে তিনি ক্যাশ মেমো করে কোম্পানি নির্ধারিত মূল্যে  লবণ বিক্রি করেছেন বলে জানান।

গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার উলপুর গ্রামের সিদ্দিক বলেন, বা’জারে ৫০-৮০ টাকা দরে লবণ বিক্রি হয়েছে।

শহরের নতুন বাজার রোডের তনু স্টোরের দীপ্ত সাহা বেশি দামে লবণ বিক্রির কথা স্বীকার করে বলেন, ‘সকালে এ লবণ ৩৫ টাকা দরে বিক্রি করেছি। বিকেলে লবণ প্রতি কেজি ২ টাকা বেশিতে কিনেছি। তাই প্রতি কেজি লবণ ৩৫ টাকার স্থলে ৪০ টাকা দরে বিক্রি করছি।’

গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসক শাহিদা সুলতানা বলেন, ‘ক্যাশ মোমো ছাড়া লবণ নিতে বারণ করেছি।’ তিনি আরো বলেন, ‘অতিরিক্ত দামে লবণ বিক্রেতার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

ইকরাম চৌধুরী টিপু, কক্সবাজার

গুজব বন্ধ করতে কক্সবাজারের লবণ চাষী, লবণ মালিক ও লবণ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে জরুরি মতবিনিময় সভা করেছে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে আয়োজিত ওই মতবিনিময় সভায় লবণের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের চাহিদার ৩ থেকে ৪ মাসের মতো লবণ মজুদ রয়েছে। কাজেই লবণের মূল্য বৃদ্ধির কোন সুযোগ নেই।

জেলা প্রশাসনের শহীদ এটিএম জাফর আলম সম্মেলন কক্ষে সভায় কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি ও দ্রব্যমূল্যের বাজার অস্থিতিশীল করলে মোবাইলকোর্টসহ কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজারের ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আশরাফুল আফসার।

জেলা প্রশাসক বলেন, ‘সরকারকে বিব্রত করতে একটি মহল নানামুখি অপপ্রচারে লিপ্ত। দেশে লবণের কোন সংকট নেই।’ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে কঠোর নজরদারিতে রাখা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

আশরাফুল আফসার জানিয়েছেন, ৩ থেকে ৪ মাসের লবণ মজুদ থাকার পরও কেউ অপপ্রচার ছড়ালে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্যাকেটের গায়ে লেখা মূল্যে লবণ বিক্রি করার জন্য  ব্যবসায়ীদের  প্রতি নির্দেশনা দেন তিনি।

শহীদুল হুদা অলক, চাঁপাইনবাবগঞ্জ

চাঁপাইনবাবগঞ্জে গুজবকে কেন্দ্র করে অতিরিক্ত দামে লবণ কেনাবেচার  অভিযোগে রাত ৮টা পর্যন্ত চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা ও শিবগঞ্জ উপজেলায় ১৩ জনকে আটক করা হয়েছে। এদের মধ্যে সদর উপজেলায় ১১ জনকে ৪০ হাজার টাকার অর্থদণ্ড প্রদান করা হয়। সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন ওই দন্ড প্রদান করেন।

এদিকে শিবগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শামসুল আলম জানান, শিবগঞ্জে দুইজনকে আটক করা হয়েছে।

মুহাম্মদ আবু তৈয়ব, খুলনা

খুলনায় হঠাৎ বেড়ে গেছে লবণের বেচাকেনা। নানা গুজবে মহানগরীসহ সমগ্র জেলাজুড়ে লবণ নিয়ে চলছে লঙ্কাকাণ্ড। দাম বাড়ানোর পাশাপাশি মজুত করার অভিযোগে ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে বাক-বিতণ্ডা। লবণ সংকটকে গুজব আখ্যা দিয়ে নগরীর বড় বাজার এলাকায় মাইকিং করছে প্রশাসন।

মঙ্গলবার দুপুরের পর থেকে রাত পর্যন্ত দোকানে লবণ ক্রয়ের জন্য ক্রেতাদের  নিত্য চাহিদার অতিরিক্ত লবণ ক্রয় করতে দেখা গেছে। ওই সময় অনেক গৃহিণীদের লবণ কেনার জন্য দোকানে ভিড় করতে দেখা যায়। আবার বড় বাজার থেকে বেশি পরিমাণ লবণ নিয়ে আসায় থানা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের সন্মুখীন হচ্ছে অনেকেই । থানা পুলিশ অতিরিক্ত লবণ থানায় নিয়ে যাচ্ছে । তবে পুলিশের পক্ষ হতে কোন ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি।

অভিযোগ উঠেছে, পেঁয়াজের দাম  একটু কম হতেই  নতুন করে গুজবে  বিভিন্ন স্থানে চলছে লবণের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির চেষ্টা। আবার কোন কোন অসাধু ব্যবসায়ী লবণের দাম আরও বৃদ্ধি পাবে এ আশঙ্কায় লবণ মজুদ করে রেখেছেন। খুলনার রমনা সল্ট মালিক সেলিম আহমেদ জানান, খুলনা পর্যাপ্ত লবণ মুজুত রয়েছে সংকটের কোন সম্ভবনা নাই ।

লবণ নিয়ে গুজবে কান না দিতে জেলা প্রশাসন ও তথ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সামাজিক মাধ্যমে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। কিন্তু তাতেও মানুষের মাঝে উদ্বেগ কমছে না।

এ ব্যাপারে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর খুলনা জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক শিকদার শাহীনুর আলম বলেন, ‘বুধবার আমরা অভিযানে নামব। অনিয়ম বা হয়রানির অভিযোগ পাওয়া গেলে জরিমানা করা হবে।’

খুলনা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হেলাল হোসেন জানান, বাজার তদারকির জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গুজব প্রতিরোধে তিন জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। মহানগরীর বাজার তদারকির জন্য এই তিন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কাজ করছেন। অনুরূপভাবে উপজেলা পর্যায়ে ইউএনওকে বাজার তদারকির জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, সারাদেশে বিভিন্ন লবণ কোম্পানির ডিলার, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাদের কাছে পর্যাপ্ত  লবণ মজুদ রয়েছে। পাশাপাশি চলতি মাস থেকে লবণের উৎপাদন মওসুম শুরু হয়েছে। সে হিসাবে লবণের কোনো ঘাটতি নেই। কাউকে গুজবে কান না দেওয়ার আহবান জানান জেলা প্রশাসক।

কাজী রাশেদ, চান্দিনা

কুমিল্লার চান্দিনায় লবণের অতিরিক্ত মূল্য বৃদ্ধির গুজব প্রতিরোধ এবং সকল পণ্যের নির্ধারিত মূল্যে বিক্রয় করার লক্ষ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন চান্দিনা উপজেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার স্নেহাশীষ দাশ এবং সহকারি কমিশনার(ভূমি) নাইমা ইসলাম।

মঙ্গলবার বিকালে চান্দিনা ও মাধাইয়া বাজারে এ অভিযান চালান তাঁরা। এসময় লবণ অতিরিক্ত দামে বিক্রয় এবং মূল্য তালিকা না থাকার অভিযোগে পাঁচ ব্যবসায়ীকে ৪২ হাজার টাকা জরিমানা করেন  ভ্রাম্যমান আদালত।