‘সন্দেহ এড়াতে হাত কেটে অজ্ঞান হওয়ার ভান করেন হত্যাকারী’
হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার দ্বিগম্বর বাজার এলাকায় গভীর রাতে মা -মেয়েকে গলাকেটে হত্যার পেছনের কারণ ছিল তাদের ঘরে থাকা অর্থ ও স্বর্ণালঙ্কার চুরি করা। পুলিশ বলছে, প্রতিবেশী ও সবজি বাজারের শ্রমিক আমীর আলী ও তাঁর দুই সহযোগী মিলে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। হত্যাকাণ্ডের পর আমীর আলী নিজেই নিজের হাত কেটে ঘরের পাশের একটি ডোবায় অজ্ঞান হওয়ার ভান করে পড়ে থাকেন, যেন তাঁকে নিয়ে কারও সন্দেহ না হয়।
হবিগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তাহমিনা আক্তারের আদালতে গতকাল শনিবার রাতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে হত্যার দায় স্বীকার করে এসব তথ্য দেন আমীর আলী। পরে গতকাল রাতে হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ উল্ল্যা প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানান।
এসপি মোহাম্মদ উল্ল্যা বলেন, ‘আমরা খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করি। পরে হবিগঞ্জের পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এবং সিলেটের পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ক্রাইম সিন ইউনিটকে জানালে তারা ঘটনাস্থলে এসে আলামত সংগ্রহে সহায়তা করে। এর মধ্যে নিহত অঞ্জলি মালাকারের গলাকাটা, ঠোঁট, গাল ও পেটে জখম এবং তাঁর মেয়ে পূজা রানীর গলা কাটা অবস্থায় পাওয়া যায়।
অঞ্জলি মালাকারের স্বামী কাঁচামালের ব্যবসায়ী সঞ্জিত রায় (৪৫) জানান, ঘটনার সময় তিনি বাড়িতে ছিলেন না। কাঁচা মরিচ কেনার জন্য তিনি সুনামগঞ্জ গিয়েছিলেন। সকালে ঘরে ঢুকে স্ত্রী ও মেয়ের রক্তাক্ত লাশ দেখতে পান তিনি।
সঞ্জিত আরও জানান, তাঁর ঘরে থাকা এক লাখ ৯০ হাজার টাকা, স্ত্রীর হাতে থাকা দেড় ভরি স্বর্ণের বালা ও স্ত্রীর ব্যবহৃত একটি অ্যান্ড্রয়েড ফোন ঘটনার দিন থেকে পাওয়া যায়নি।
তদন্তকালে ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে তিনতলা বিশিষ্ট ওই বাড়ির দ্বিতীয় তলার ভাড়াটিয়া সিলেটের শাহপরান থানাধীন চৌকিদিঘি এলাকার আমীর আলীকে (৩০) গ্রেপ্তার করা হয়। ঘটনার তদন্তে ও আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে জানা যায়, অঞ্জলির স্বামী সঞ্জিত ও আমীর আলী পূর্ব পরিচিত। তাঁরা দুজন একসঙ্গে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। সঞ্জিতের পরিচিত বিধায় আনুমানিক তিন মাস আগে ওই বাসার দ্বিতীয় তলায় স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ভাড়ায় থাকতে শুরু করেন আমীর আলী।
কিছুদিন আগে অর্থের প্রয়োজন হলে সঞ্জিতের বাসায় গিয়ে তিন হাজার টাকা ধার নেন আমীর আলী এবং জানতে পারেন সঞ্জিতের ঘরে প্রায় দুই লাখের মতো টাকা রয়েছে। এরপরই ওই টাকা ও ঘরে থাকা স্বর্ণালঙ্কার চুরির জন্য ফাঁদ পাততে থাকেন আমীর আলী। এ বিষয়ে তিনি তাঁর এক ঘনিষ্ঠ সহযোগীর সঙ্গে আলোচনা করেন।
এর মধ্যেই গত বুধবার সঞ্জিত কাঁচামাল কেনার জন্য সুনামগঞ্জে যান এবং তাঁর ফিরতে ফিরতে পরদিন সকাল হবে বলে জানতে পারেন আমীর আলী। এর মধ্যে সুযোগ পেয়ে টাকাগুলো হাতিয়ে নেওয়ার জন্য বাহুবল উপজেলার নোয়াঔ গ্রামের মনির মিয়াসহ (৪৭) দুই সহযোগীর সঙ্গে পরিকল্পনা করেন আমীর।
পরিকল্পনা অনুযায়ী বুধবার রাত ১০টার দিকে সঞ্জিতদের বাসার মেইন সুইচ থেকে বিদ্যুতের লাইন কেটে দেন আমির আলী ও তাঁর সহযোগীরা। দিবাগত রাত ২টার দিকে আমীরের বাসায় একত্রিত হন তিনজন। সঞ্জিতের ঘরের দরজা খোলার জন্য আমীর কৌশল অবলম্বন করেন। তিনি সঞ্জিতের স্ত্রী অঞ্জলিকে দিবাগত রাত ৩টা ১০ মিনিটের দিকে ফোনে কল দিয়ে জানান, তাঁদের বাসায় চুরি হয়েছে এবং চোরেরা তাঁর টিভি, সেলাই মেশিন চুরি করে নিয়ে গেছে।
অঞ্জলি মালাকার যেন চুরির ঘটনাটি বিশ্বাস করেন, সেজন্য আমীর আলী একটি রশি ওই বাড়ির ছাদে বেঁধে সঞ্জিতদের বাসার বারান্দার সামনে দিয়ে ঝুলিয়ে রাখেন। অঞ্জলি তাঁর ঘরে না আসায় সঞ্জিতকে ফোন দিয়ে আমীর আলী বলেন, ‘আমার ঘরে চুরি হয়েছে, অথচ তোমার স্ত্রী আমাকে দেখতে এল না।’ সেইসঙ্গে সঞ্জিত বর্তমানে কোথায় আছে তা জানতে চান আমীর। তখন সঞ্জিত জানান, তিনি সুনামগঞ্জে আছেন। এরপর আমীর তাঁর সহযোগীদের সঙ্গে তিনতলায় সঞ্জিতদের বাসার দরজার সামনে যান এবং সঞ্জিতদের বাসার দরজায় কড়া নেড়ে দরজা খুলতে বলেন। এ সময় অঞ্জলি দরজা খুললে আমীর ও মনিরসহ তিনজন অঞ্জলির মুখ চেপে বাসার ভেতরের কক্ষে নিয়ে যান। এরপর প্রথমে অঞ্জলির মুখ ও শরীরে আঘাত করে এবং পরে গলাকেটে তাঁকে হত্যা করেন তাঁরা। এ সময় ঘরে থাকা অঞ্জলির মেয়ে পূজা ঘুম থেকে উঠে কাঁদতে থাকলে তাকেও গলাকেটে হত্যা করা হয়।
এরপর তাঁরা অঞ্জলির ঘরের ড্রয়ারে থাকা এক লাখ ৯০ হাজার টাকা ও অঞ্জলির ব্যবহৃত একটি অ্যান্ড্রয়েড ফোন নিয়ে যান। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ছোরা ও মোবাইল ফোনটি তাঁরা ঘটনাস্থলের পাশের একটি ডোবায় ফেলে দেন।
এ ঘটনায় যেন কেউ আমীর আলীকে সন্দেহ না করে, সেজন্য তিনি নিজের বাঁ হাতের পাতায় কাটা দাগ সৃষ্টি করেন। এ ছাড়া ডাকাতরা তাঁকে মেরে বাড়ির পাশের ডোবায় ফেলে রেখে গেছে—এটি বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য তিনি অজ্ঞান হওয়ার ভান করে পড়ে থাকেন।
পরে ঘটনার দিন এলাকাবাসী আমীরকে উদ্ধার করে প্রথমে বাহুবল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও পরে হবিগঞ্জ আধুনিক সদর হাসপাতালে পাঠায়।
এসপি মোহাম্মদ উল্ল্যা জানান, আসামি আমীর আলীর স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ঘটনার সঙ্গে জড়িত মনির মিয়াকে শনিবার দুপুরে গ্রেপ্তার করে বাহুবল মডেল থানা পুলিশ। পরে আসামিদের মাধ্যমে তথ্য পেয়ে ঘটনাস্থলের পাশের একটি ডোবা থেকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ছোরা, মোবাইল ফোন এবং আমীর আলীর ঘর থেকে কিছু টাকা উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে অপর আসামিকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
এক প্রশ্নের জবাবে এসপি বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডের আগে মা ও মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়েছে কি না, এ ব্যাপারে আসামি আমীর আলী কোনো তথ্য দেননি। তবে ময়নাতদন্তে যাতে বিষয়টি পরীক্ষা করা হয়, তার জন্য চিকিৎসকদের বলা হয়েছে। চিকিৎসকেরা নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য ল্যাবে পাঠিয়েছেন।’
এর আগে বাহুবল মডেল থানায় অজ্ঞাত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। নিহত অঞ্জলির স্বামী সঞ্জিত দাস বাদী হয়ে গত শুক্রবার রাতে মামলাটি করেন।