সাংবাদিকের বিরুদ্ধে যৌতুক ও ভ্রুণ হত্যার অভিযোগে মামলা
এক মাস আগে সংবাদমাধ্যম সমকালের সাংবাদিক পারুল আক্তার (৩৫) ও যুগান্তরের সাংবাদিক রেজাউল করিম প্লাবন (৩৭) বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন। এরই মধ্যে প্লাবনের বিরুদ্ধে যৌতুকের জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন এবং ভ্রুণ হত্যার অভিযোগ এনেছেন পারুল। রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় একটি মামলাও করেছেন তিনি। গতকাল সোমবার বেলা ১১টার দিকে থানায় উপস্থিত হয়ে মামলাটি করেন পারুল।
এ তথ্য নিশ্চিত করে পারুল এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমি প্লাবনের বিরুদ্ধে যৌতুক, নির্যাতন ও ভ্রণ হত্যার অভিযোগ এনে মামলা করেছি।’
পারুলের করা মামলার একটি কপি এনটিভি অনলাইনের কাছেও রয়েছে। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ‘গত ২ এপ্রিল রেজাউল করিম ওরফে প্লাবনের সঙ্গে প্রণয় সূত্রে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হই। আমি পেশায় একজন সাংবাদিক হওয়ায় তাঁর সঙ্গে আমার প্রায়ই দেখা ও কথাবার্তা হতো। সেই সূত্রে তাঁর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়। সেই ঘনিষ্ঠতার পর তাঁর আগ্রহ ও অনুনয়ের প্রেক্ষিতে আমাদের মধ্যে প্রণয় সৃষ্টি হয়। পরে আমরা রেজিস্ট্রি বিবাহ সম্পন্ন করি। পরে আমার স্বামীর বর্তমান ঠিকানা কসমো পলিটন হালিম নিবাস, ১৪/ই, মীরবাগ, ঢাকা—১২১৭ তে বসবাস করতে শুরু করি।’
এজাহারে বলা হয়, ‘স্বামীর সঙ্গে ঘর-সংসার শুরুর পরই আমাকে তাঁর পিত্রালয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করি। তখন আমার স্বামী প্লাবন জানায় যে, তোমাকে আমাদের বাড়িতে নিতে গেলে আমাকে একটি ফ্ল্যাট কিনে দিতে হবে। নয়তো নগদ ৫০ লাখ টাকা দিতে হবে। প্রণয় থেকে বিয়ে হলেও বিয়ের পর তাঁর এই চেহারা দেখে আমি বুঝতে পারি, আগের ভালোবাসা সবই ছিল তাঁর অভিনয়। প্রতারণা করেই যৌতুকের লোভে সে আমাকে বিয়ে করেছে। বিয়ের পরই আমি জানতে পারি, বিভিন্ন নারীর সঙ্গে তাঁর অনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। তবু তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করি। আমি বলি, পছন্দসূত্রে আমরা পরস্পর পরস্পরকে বিয়ে করেছি, এখানে আমার পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো যৌতুক দেওয়া হবে কেন? তাঁকে আরো বলি, আমাদের ঢাকার একপ্রান্তে একটি বাড়ি আছে সত্য। কিন্তু সেটি বিক্রি করেও তোমাকে ফ্ল্যাট কিনে দেওয়ার মতো অর্থ সংগ্রহ করা যাবে না। তাছাড়া শুধু আমার জন্য মা-বাবা সেটি করতে যাবেন কেন? তাঁদের তো আরো সন্তান রয়েছে। এরপর আমার ওপর শারীরিক নির্যাতন করা প্লাবনের নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে যায়। আমি সামাজিক মর্যাদার ভয়ে চুপ করে থাকি।’
এজাহারে আরো বলা হয়, ‘এই অবস্থার দিন কয়েক পর প্লাবন আমাকে জানায়, বাড়িতে তাঁর মা খুবই অসুস্থ। তাঁকে জরুরিভিত্তিতে কুড়িগ্রামের চিলমারীর নিজ বাড়িতে যেতে হবে। যেহেতু আমার শাশুড়ি অসুস্থ হয়েছেন, সে কারণে আমি তাঁর সঙ্গে যেতে চাই। তখন সে বলে, এ অবস্থায় তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এই নিয়ে মৃদু বাকবিতণ্ডার পর সে আমাকে প্রচণ্ড মারধর করতে শুরু করে। আমি তাঁকে বলি, দেখ আমার প্রেগেন্সি পরীক্ষা পজিটিভ এসেছে। আমার গর্ভে তোমার সন্তান। এতে সে ক্ষিপ্ত হয়ে আরো বেশি মারতে শুরু করে। আমার পেটের ওপর প্রবল চাপ প্রয়োগ করে। এরপর আমাকে বাসায় ফেলে রেখেই সে মোটরসাইকেলে করে নিজ বাড়িতে চলে যায়। বাড়ি চলে যাওয়ার পর আমি গর্ভাবস্থায় নারীদের যেসব অসুবিধা হয়, সেগুলো স্বামীকে জানাই। সে এই কথা জানার পরও তাঁর মায়ের অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে ঢাকায় আসতে পারবে না বলে জানিয়ে দেয়।’
মামলার এজাহারে বলা হয়, ‘আমি আমার মা-বোন এবং ঘনিষ্ঠ কয়েকজন বন্ধু-বান্ধবীর সঙ্গে পরামর্শ করি। তাঁরা আমাকে বলে, যদি তুমি একটু সুস্থ বোধ করো, তাহলে যেহেতু তোমার শাশুড়ির মরণাপন্ন অবস্থা, তুমি নিজেই শ্বশুরবাড়িতে যাও। করোনাকালের এই লকডাউনে ঢাকার বাইরে যাওয়া খুবই কঠিন। আমার আকুলতায় আমাদের সাংবাদিকদের সংগঠন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক রিয়াজ চৌধুরী আমাকে একটি অ্যাম্বুলেন্স ঠিক করে দেন। আমি নিজে যথেষ্ট অসুস্থ থাকার পরও কর্তব্য মনে করে শয্যাশায়ী শাশুড়িকে দেখার জন্য অ্যাম্বুলেন্সে চিলমারীতে যাই। গত ৫ মে বিকেলে আমি চিলমারী পৌঁছাই। সেখানে যাওয়ার পর সাংবাদিকতার সুবাদে পূর্ব পরিচিত আমার পত্রিকা দৈনিক সমকালের চিলমারী প্রতিনিধি নাজমুল হুদা পারভেজ ও তাঁর কয়েকজন সাংবাদিক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে বিকেল সাড়ে ৪টা নাগাদ আমার শ্বশুরবাড়িতে যাই। শ্বশুরবাড়ির সামনে গিয়ে ডাকাডাকি করেও আমার স্বামীর সাড়া পাই না। এমন সময় আমার স্বামীর বড় ভাই এম এ আজিজ ও ছোট ভাই এস এম নিজাম উদ্দিনসহ আমার শ্বশুর ও শ্বাশুড়ি বেরিয়ে আসেন। আমি শ্বশুর ও শাশুড়ির পায়ে সালাম করতে গেলে তাঁরা পা সরিয়ে নেন এবং আমাকে পুত্রবধূ হিসেবে অস্বীকার করেন। তাঁরা সবাই আমাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে শুরু করেন। একপর্যায়ে আমার শাশুড়ি আমার প্রতি মারমুখী হয়ে তেড়ে আসেন। তিনি ওই সময় বলেন, আমার ছেলে যা চেয়েছে, তা পূরণ করতে পারলে এই বাড়িতে আসবে। তিনিও তাঁর ছেলের যৌতুক চাওয়ার বিষয়টি সমর্থন করেন। এটা তাঁর এ কথায় আমি বুঝতে পারি।’
এজাহারে আরো উল্লেখ করা হয়, ‘শ্বশুরের পরিবারের সবাই মিলে আমার সঙ্গে অত্যন্ত দুর্ব্যবহার করতে থাকেন। একপর্যায়ে আমি তাঁদের জিজ্ঞাস করি, আমার শাশুড়ির অসুস্থতার কথা বলে প্লাবন বাড়ি এসেছে। সে বলেছিল শাশুড়ি মরণাপন্ন অবস্থায় রয়েছেন। আমি এখন দেখছি শাশুড়ির কোনো অসুস্থতাই নেই। তিনি আমাকে মারতে আসছেন। তখন আমার ভাসুর-দেবর মিলে বলতে থাকেন, প্লাবন বলে গেছে ঢাকায় একটি ফ্ল্যাট বাড়ি কিনে দিতে হবে, অথবা নগদ ৫০ লাখ টাকা যৌতুক দিতে হবে, তাহলেই তুমি স্বীকৃতি পাবে। আমি এর প্রতিবাদ করলে পরিবারের সবাই মিলে আমাকে চড় থাপ্পর ও চুল ধরে টানা-হেঁচড়া করতে থাকে। এতে আমি শারীরিকভাবে আহত হই এবং আমার সামাজিক মর্যাদা হেয় প্রতিপন্ন হয়। আমার সঙ্গে থাকা সাংবাদিকরা আমাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য চিলমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান।’
এজাহারে আরো বলা হয়, ‘পরে সেখান থেকে আমি মামলা করার জন্য চিলমারী থানায় যাই। থানায় কর্মরত পুলিশ সদস্যরা আমাকে বলেন, যেহেতু আপনাদের বিয়ে-সংসার সবই ঢাকায়, তাই ঢাকায় গিয়ে মামলা করেন। পরের দিন ঢাকায় ফিরে আমি আরো অসুস্থ হয়ে পড়ি। এরই মধ্যে আমার গর্ভের ভ্রুণটি নষ্ট হয়ে যায় এবং চলাচলের শক্তি হারাই। যৌতুকের দাবিতে স্বামীর নির্যাতন এবং মানসিক অশান্তির কারণে আমার গর্ভের সন্তানটি নষ্ট হয়েছে। আমি আমার স্বামী রেজাউল করিম প্লাবনের বিরুদ্ধে যৌতুকের জন্য নির্যাতন এবং ভ্রুণ হত্যার অভিযোগ আনছি। আমাদের অনাগত সন্তানটি তার নির্যাতনের কারণে পৃথিবীর মুখ দেখতে পারেনি। চিলমারী থেকে ফিরে গর্ভপাতজনিত কারণে আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি।’
এ বিষয়ে প্লাবন জানান, গত ৩০ এপ্রিল পারুল আক্তারকে তালাকের নোটিশ পাঠিয়েছেন তিনি।
এদিকে পারুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে প্লাবন জানান, শরীয়াহ মোতাবেক আগে কোনো বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ থাকলে সেটা স্বামী-স্ত্রী উভয়কেই জানাতে হয়।
প্লাবন দাবি করেন, বিয়ের পর তিনি জানতে পারেন, তাঁর স্ত্রীর আগে আরো একটি বিয়ে হয়েছে এবং তাঁর সঙ্গে পারুলের দ্বিতীয় বিয়ে। এ ছাড়া সারা রাত জেগে ফোনালাপ, অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক ও উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনসহ নানা কারণে প্লাবন পারুলকে ডিভোর্স দিয়েছেন বলেও দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘এ বিষয়গুলো আমি তালাকের নোটিশেও উল্লেখ করেছি।’
এ বিষয়ে পারুল আক্তার জানান, তিনি আইনগতভাবে এখনো কিছু পাননি। হোয়াটস অ্যাপে তাঁকে একটি ‘ডিভোর্স লেটার’ পাঠানো হয়েছে। এটার কার্যকারিতা সম্পর্কে তিনি নিশ্চিত নন বলেও জানান।