‘সুন্দরমত কাইট্যা তুলছি, ধানও কুব ভালো হইছে’

নেত্রকোনার হাওরাঞ্চলের নিচু জমির ৮৫ থেকে ৯০ ভাগ ধান কাটা শেষ করে ফেলেছেন কৃষকেরা। হাওরপাড়ের কৃষকদের মধ্যে গত কয়েকদিনের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা শেষে ফিরেছে স্বস্তি। ভালো ফলন ও আশানুরুপ দাম পাওয়ায় কৃষকের আনন্দ বিস্তৃত হয়েছে দিগন্ত জুড়ে।
জেলা কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, জেলার মদন, মোহনগঞ্জ ও খালিয়াজুরী উপজেলার হাওর এলাকায় এবার ৪০ হাজার ৮৬৫ হেক্টর জমি আবাদ হয়েছে। জেলাজুড়ে বোরো আবাদ হয়েছে এক লাখ ৮৪ হাজার ৫৩০ হেক্টর জমিতে। শ্রমিক সংকট ও আগাম বন্যার ঝুঁকিতে ছিল প্রায় দুই লাখ ৫০ হাজার ৩৫০ হাজার মেট্রিকটন বোরো ধান। সারা জেলায় এই মৌসুমে বোরোর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় প্রায় ১১ লাখ ১৯ হাজার ৫৬১ মেট্রিকটন ধান।
মদন, মোহনগঞ্জ, খালিয়াজুরী উপজেলা এবং কলমাকান্দা ও আটপাড়ার একাংশ নিয়ে হাওর এলাকায় জমির ধান কাটা নিয়ে একদিকে প্রতি বছরের মতো আগাম বন্যার শঙ্কা অপরদিকে করোনাভাইরাসের কারণে উত্তরবঙ্গসহ বিভিন্ন জেলা থেকে শ্রমিক কম আসা। সময়মতো ধানকাটা শুরু হলেও শ্রমিক সংকট এবং আবহাওয়ার পূর্বাভাসের কারণে ২০ থেকে ২৫ দিন আগে থেকে কৃষকদের মধ্যে চলছিল উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা।

জেলা ও স্থানীয় প্রশাসন ৬৪টি ধান কাটা মাড়াইয়ের আধুনিক যন্ত্র হারভেস্টার ও ৪০টি রিপার মেশিনের ব্যবস্থাসহ প্রশাসনের তদারকিতে বিভিন্ন জেলার শ্রমিকদের আনার ব্যবস্থা করে। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, কৃষকলীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরাও নামেন হাওরের ধান কাটায়। বাদ যায়নি পুলিশ, আনসার ভিডিপিসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। এতে হাওরের ঝুঁকিতে থাকা নিচু জমির পুরো ধান কাটা প্রায় শেষের পথে। এখন চলছে উঁচু জমির ধান কাটা। এ নাগাদ আবাদি জমির ৭০ থেকে ৮০ ভাগ ধান কাটা শেষ হয়েছে। একর প্রতি ৬০ থেকে ৭০ মন ফলন পেয়েছে কৃষকরা। ধান গোলায় তুলতে চলছে তোড়জোড়।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ হাবিবুর রহমান জানান, গতকাল পর্যন্ত হাওর এলাকায় প্রায় ৮৬ ভাগ ধান কাটা শেষ হয়েছে। কৃষকদের পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠনও ধান কাটায় কৃষকদের সহায়তা করছে। সব মিলে ১৩ হাজার ৭০০ শ্রমিক প্রতিদিন ধান কাটছে। সঙ্গে রয়েছে ৬৪টি হারভেস্টার এবং ৪০টি রিপার মেশিন। মাঠে রয়েছে জেলা পুলিশ কর্তৃক গঠিত তিন উপজেলা তদারকির জন্য তিনটি সার্বক্ষণিক পুলিশ টিম। এই করোনা দুর্যোগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এবং আগাম বন্যার হাত থেকে বোরো ফসলকে রক্ষায় দ্রুতগতিতে ধান কেটে তা ঘরে তুলছে কৃষক। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে হাওর উপজেলার সমতল জমিসহ অন্য উপজেলারও ধান কাটা প্রায় শেষ হয়ে যাবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আক্তারুজ্জামান মদন, মোহনগঞ্জ ও খালিয়াজুরী হাওর এলাকা পরিদর্শন শেষে এই প্রতিনিধিকে বলেন, ‘যেভাবে ধান কাটা শেষ হচ্ছে, তাতে কৃষকরা খুশি। এখন অতিবৃষ্টি হলেও বাঁধের কারণে ধানের আর কোনো ক্ষতি হবে না।’

মোহনগঞ্জের ডিঙ্গাপোতা হাওরের কৃষক রসুল মিয়া বলেন, ‘হাওরে কুব শান্তিমতো ধান কাটতাছি। অন্য বছরতো বন্যায় নেয়গা, খরানে নেয়গা, পানিয়ে নেয়গা। এই বছর নিছে না। সুন্দরমতো কাইট্যা তুলছি। আরো কাটতেও আছি। ধানও কুব ভালো অইছে। ফসল খুব সুন্দর অইছে।’
অপর কৃষক মাঘান গ্রামের আবু তাহের বলেন, ‘আল্লায় দিলে এইবার ফলন ভালা অইছে। হাওরে ৭ মণ কইরা ধান অইছে কাঠা প্রতি। প্রায় কাটা শেষ, কিছু রইছে। যা কাটছি তা মাচায় তুলতাছি।’
খালিয়াজুরীর কির্তনখলা হাওরের শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এখন আমাদের নিচু জমি যেইডা কাটা শেষ হইয়া আইছে। টুকটাক কিছু রইছে ইরিজমি ছক্কা। এইডাও দুই-চারদিনের মদ্যে কাটা অইয়া যাবোগা। যা আছে দুই-চারদিনের মদ্যে কাভার হইয়া যাবোগা। সমস্যা নাই। অহন যদি অগ্রিম বন্যা আসেও তাইলেও আমাদের কোনো সমস্যা করত না। এখন ধান সিদ্দ করতাছি। পরে গোলায় তুলব।’
কৃষক স্বাগত সরকার বলেন, ‘নিচা জমি আমরার সুন্দরমতনই উটছে, কোনো সমস্যা হইছে না। বন্দের জমি প্রায় শেষই। উপরের দাওয়া সাধারণ কিচু রইছে। ধান ফসলও ভালো মতো পাইছি। ৭৫০ থাইকা ৮০০ টাকা মণ দর পাইছি। অহন বন্যা হইলেও সমস্যা অইত না।’

ডিঙ্গাপোতা হাওরের কৃষক আব্দুল হান্নান রতন বলেন, ‘ডিঙ্গাপোতা হাওর তথা জেলার অন্যান্য উপজেলার হাওরগুলোতে জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বিভাগ, সর্বোপরি কৃষি বিভাগ এবার ধান লাগানো থেকে শুরু করে ধান কাটায় ব্যাপক নজরদারি করেছে। এবার ফলন হয়েছে, দামও পেয়েছি ভালো। আগামী বোরো মৌসুমে আমাদের হাওরাঞ্চলের কৃষকরা আর খণ্ড জমিও পতিত রাখব না।’
নেত্রকোনা জেলা প্রশাসক মঈনউল ইসলাম বলেন, ‘আমি ইতিমধ্যে হাওর উপজেলাগুলো একাধিকবার পরিদর্শন করেছি। প্রতি বছরই হাওরের ধান কাটা নিয়ে আমরা একটু সংকটে থাকি, শংকায় থাকি। কারণ ধান কাটার জন্য অত্যন্ত কম সময় পাওয়া যায়। এ বছরও শঙ্কা ছিল। আবহাওয়ার পূর্বাভাস ছিল। ইতিমধ্যে নেত্রকোনা হাওরের যে কৃষিজমি আছে তাতে বোরো ধান চাষ হয়। এর ফলন অত্যন্ত ভালো হয়েছে। দামও ভালো পেয়েছে। কৃষকরা অত্যন্ত খুশি। হাওরের ধান কাটা শেষের পথে।’
‘হাওর এলাকার পর্যাপ্ত শ্রমিক ও হারভেস্টার দিয়ে বেশিরভাগ জমির ধান কাটা হয়েছে। শ্রমিকদের অন্য জেলা থেকে আনা-নেওয়ার ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসন পুলিশের সহযোগিতায় কাজ করেছে। আর চার-পাঁচদিনের মধ্যে বাকি ধান কাটা শেষ হবে। হাওরে এবারের আড়াই লাখ মেট্রিকটন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রার পুরোটাই অর্জিত হবে।’ করোনা পরিস্থিতিতে খাদ্য সংকট দেখা দিলে এই ধান সহায়ক হবে বলেও জানান জেলা প্রশাসক।