স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ব্যাপক রদবদল হচ্ছে
করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণের শুরু থেকে স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট নানা অনিয়মের ঘটনা উঠে আসে জনসম্মুখে। ফলে বিতর্কের মুখে পড়ে সরকার ও স্বাস্থ্য খাত। এই বিব্রতকর বিতর্কের অবসান ঘটাতে আর স্বাস্থ্য খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। উদ্যোগের অংশ হিসেবে এরই মধ্যে মন্ত্রণালয়ের সচিব, অতিরিক্ত সচিবসহ কয়েকজনকে বদলি করা হয়েছে। পদত্যাগ করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকও (ডিজি)।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অন্তত ১৫ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে রদবদলের চিন্তাভাবনা করছে সরকার। সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) ডা. আমিনুল হাসানকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁর স্থলে আজ বৃহস্পতিবার ডা. ফরিদ হোসেন মিয়াকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
দ্রুতই একে একে আরো কয়েকজনকে সরানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে হাঁটছে সরকার। স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
তবে স্বাস্থ্য খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মাত্র কয়েকজনকে সরিয়ে এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। শৃঙ্খলা ফেরাতে ঢেলে সাজাতে হবে পুরো স্বাস্থ্য খাতকে।
করোনাকালের এই বির্তকের শুরুটা ছিল চিকিৎসকদের নিম্নমানের মাস্ক সরবরাহ করা নিয়ে। এরপর সব ঘটনাকে ধামাচাপা দিয়ে শুরু হয় করোনার নমুনা পরীক্ষা না করে ইচ্ছেমতো রিপোর্ট প্রদান প্রসঙ্গের দুর্নীতি। রাজধানীর বেসরকারি রিজেন্ট হাসপাতাল ও জেকেজি হেলথ কেয়ারের এই জালিয়াতির ঘটনায় আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয় দেশজুড়ে। প্রশ্ন উঠে, কার ইন্ধনে বা ক্ষমতাবলে প্রতিষ্ঠান দুটি এই ধরনের অপরাধমূলক কাজ করার সাহস পেল। এতে আরো বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
পরে সমালোচনার মুখে বাধ্য হয়ে অধিদপ্তরটির পক্ষ থেকে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে ওই দুটি প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে একটি ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। ব্যাখ্যায় রিজেন্ট হাসপাতালের কোভিড-১৯ চিকিৎসায় যুক্ত হওয়ার কথা বলতে গিয়ে বলা হয়, ‘মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্দেশিত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল বিভাগ সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের উদ্যোগ নেয়।’
তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এ মন্তব্যের বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় মহাপরিচালকের কাছে ব্যাখ্যা চায়। শুধু তাই নয়, দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব আরো দুই-তিন বছর থাকবে-এমন বক্তব্যের জন্যও মন্ত্রীদের তোপের মুখে পড়তে হয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজি অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদকে। নানা আলোচনা-সমালোচনার শেষে অবশেষে আবুল কালাম আজাদ গত মঙ্গলবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে তাঁর পদত্যাগপত্র জমা দেন। তার পরপরই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) ডা. আমিনুল হাসানকে সরিয়ে দেয় সরকার।
তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমরাও শুনেছি একটি বড় রদবদল হতে যাচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভিন্ন বিভাগে। অন্তত ১৫ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে সরানোর কথা শুনছি। এই নিয়ে নানা আলোচনা চলছে অধিদপ্তরটিতে। রিজেন্ট হাসপাতাল ও জেকেজি হেলথ কেয়ার কাণ্ডের পর অনেকেই ভয়ে আছেন। ডিবির জিজ্ঞাসাবাদেরও আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ। ইতোমধ্যে গোপনে গোপনে অধিদপ্তরের মধ্যম পর্যায়ের কয়েকজনকে বদলি করা হয়েছে। ’
ব্যাপক রদবদলের বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা (প্রশাসন) বলেন, ‘রদবদলের সিদ্ধান্ত নেবে মন্ত্রণালয়। এই সিদ্ধান্ত আমার জানার কথা না। তবে আপনি যেমন শুনছেন, আমিও নানা স্থান থেকে এসব কথা শুনছি। যে সিদ্ধান্ত নিলে ভালো হবে মন্ত্রণালয় সেই সিদ্ধান্ত নেবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে ডা. নাসিমা সুলতানা বলেন, ‘আমাদের ডিজি পদত্যাগ করেছেন। তবে আমাদের কাজের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। একটি অধিদপ্তরের অনেক কর্মকর্তা আছেন। কাজ চালিয়ে নিচ্ছি। সমস্যা হচ্ছে না।’
জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দুই-একজন কর্মকর্তাকে বদল করে আলটিমেটলি খুব একটা পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। পরিবর্তন করার মনোভাব থাকলে সব কিছু ঢেলে সাজাতে হবে। তাহলে যদি কিছুটা ভাবমূর্তি ফেরে। ডিজি পদত্যাগ করেছেন। এখন এমন একজনকে নিয়োগ দিতে হবে যাতে তিনি সব কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখেন। এ ছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ ও সমন্বয় থাকতে হবে।’
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল মান্নান এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে যেসব কর্মকর্তা অধিক বিতর্কিত তাঁদের বিরুদ্ধে আমরা চিন্তা-ভাবনা করছি। অধিদপ্তরটির হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহের পরিচালককে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আরো কয়েকজনের বিষয়ে আমরা আলোচনা করছি। দেখা যাক, সময়ের সিদ্ধান্ত সময়েই পেয়ে যাবেন।’
এসব বিষয়ে গতকাল বুধবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘ডিজি (আবুল কালাম আজাদ) পদত্যাগ করেছেন। নিয়ম অনুযায়ী এটা জনপ্রশাসনে গেছে। জনপ্রশাসন সিদ্ধান্ত নেবে পরবর্তী পদক্ষেপ তারা কী নেবে।’
নতুন ডিজি নিয়োগের বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘পদত্যাগপত্র যেটা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে গেছে এ বিষয়ে আগে আমাদের কাছে সিদ্ধান্ত আসুক, তারপর আমরা চিন্তাভাবনা করে আরো উচ্চপর্যায়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে পারব। অবশ্যই সবাই মিলে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। দরকার হলে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করা হবে।’
অনিয়মের সঙ্গে জড়িত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আরো কিছু কর্মকর্তার নাম এসেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না, জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা দেখব যেখানে প্রয়োজন পরিবর্তনের, সেখানে পরিবর্তন করা হবে। আমরা চাই এখানে সুষ্ঠু পরিচালনা হোক, মানুষ সেবা পাক।’