স্লুইস গেইট যেখানে ২০ হাজার পরিবারের গলার কাটা

Looks like you've blocked notifications!
স্লুইস গেইটের কারণে ধান ও মাছ চাষ নিয়ে বিপাকে পড়েছে স্থানীয়রা। ছবি : এনটিভি

একটি স্লুইস গেইটের কারণে মোংলার পাঁচটি গ্রামের প্রায় পাঁচ হাজার একর জমিতে ধান ও মাছ চাষ নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন স্থানীয় প্রায় ২০ হাজার পরিবার। স্লুইস গেইটটির অব্যবস্থাপনায় জোয়ারের পানি নদী থেকে খালে ঢুকতে না পারায় ফসলি জমিতে পানি উঠছে না। জোয়ারের পানির অভাবে আট বছর ধরে হচ্ছে না ধান চাষ। সবখানে জানিয়েও মিলছে প্রতিকার।

জানা যায়, মোংলা পোর্ট পৌরসভার নয় নম্বর ওয়ার্ড ও উপজেলার চাঁদপাই ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে কাইনমারী খাল। এই খালের পানির উপরই নির্ভর করে উপজেলার চাঁদপাই ইউনিয়নের মালগাজী, কাইনমারী, শাহজালাল পাড়া, ব্রাক্ষণমাঠ ও চিলা ইউনিয়নের হলদিবুনিয়া গ্রামের ফসলি জমির চাষাবাদ। কিন্তু আট বছর আগে জলোচ্ছ্বাসের প্লাবন রোধে কাইনমারী খালের মুখে স্লুইস গেইট নির্মাণ করে পৌরসভা কর্তৃপক্ষ। সেই থেকেই পানির অভাবে ক্ষতিতে পড়েন এই পাঁচটি গ্রামের কৃষি পরিবার। ক্ষতির মুখে পড়লে শুরুতেই তাঁরা ছুটে যান পৌরসভা কর্তৃপক্ষের কাছে। কর্তৃপক্ষ তাদের আশ্বাস দেন, আগামীতে পানির সমস্যা হবে না, জমিতে তিন ফসল চাষের পানি স্লুইস গেইট দিয়ে সরবরাহ করা হবে।

সর্বশেষ গত ২১ আগস্ট গ্রামবাসী স্লুইস গেইট সব সময় খোলা রাখার দাবিতে খুলনা সিটি মেয়র, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা চেয়ারম্যান ও পৌরসভার মেয়রের কাছে লিখিত আবেদন জানিয়েছেন। যখনই গ্রামবাসী স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের দারস্থ হন, তখনই দুই-একদিন গেইটি খুলে রেখে আবারও তা বন্ধ রাখা হয়। গেইট দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে পৌর শহর প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কায় গেইটি বন্ধ রাখা হয় বলে গ্রামবাসীর অভিযোগ। শহর তলানোর অজুহাতে গেইটটি বন্ধ রেখে হাজার হাজার একর কৃষি জমি ধ্বংস করা হচ্ছে বলেও ক্ষোভ প্রকাশ করে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো। গেইটটি খোলা রাখার দাবিতে গতকাল রোববার সকালে মালগাজী এলাকায় বিক্ষোভ প্রদর্শন করে জমির মালিক শত শত নারী-পুরুষ।

সরেজমিনে মালগাজী, কাইনমারী ও শাহজালাল পাড়াসহ ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, যে জমিতে এখন এক হাত পানি থাকার কথা সেখানে এক ফোটাও পানি নেই। জমিতে ধানের চারা রোপন করতে হলে সাধারণত নয় ইঞ্চি পানির প্রয়োজন। সেই পানি না থাকায় জমি চাষ করতে পারছেন না চাষিরা। অপরদিকে গেল বর্ষায় কেউ কেউ চাষ করতে পারলেও এখন পানির অভাবে ও রোদের তাপে তা পুড়ে বিবর্ণ হয়ে মারা যাচ্ছে। পানির অভাবে শুকিয়ে ঘরগুলোতে মারা যাচ্ছে কাকড়া ও চিংড়ি মাছ।

বৃষ্টির পানিতে জমি চাষাবাদ করে ফসল রোপন ও ঘেরে মাছ ছাড়েন স্থানীয়রা। কিন্তু বর্তমানে পানির অভাবে ধান ও মাছ চাষ দুইই হুমকিতে পড়েছে। দুই-চারদিনে বিলে পানি না উঠলে রোপনকৃত ধান ও ঘেরে ছাড়া মাছ সবই মরে যাবে বলে জানিয়েছেন তাঁরা। পানির চাহিদা মেটাতে কেউ কেউ খালের সঙ্গে শ্যালো মেশিন দিয়ে জমিতে পানি দিচ্ছে। সমুদ্র উপকূলীয় মোংলায় শ্যালো মেশিন দিয়ে জমিতে পানি দেওয়ার চিত্র প্রকৃতির সঙ্গে যেন এক ধরনে রসিকতা। পানিতে তলানো উপকূলে জোয়ারের পানির অভাবে মেশিন দিয়ে জমিতে পানি দেওয়ার চিত্রটিও যেন বিলাসিতা।

চাঁদপাই গ্রামের হাবিব মোল্লা বলেন, ‘কাইনমারী খালের স্লুইস গেইটটি নিয়ন্ত্রণ করে পৌরসভা। গেইটির কারণে আমাদের জমিতে এই আট বছর ধান ও মাছ পাইনা। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, ইউএনও, উপজেলা চেয়ারম্যান, খুলনা সিটি মেয়র ও উপমন্ত্রী মহোদয়ের কাছে জানানোর পরেও আমরা কোনো প্রতিকার পাইনি। কয়েকদিন আগের বৃষ্টির সময় আমরা ধান লাগিয়েছি। এখন বৃষ্টি কমে গেছে, তাই জমি শুকিয়ে ফেটে গেছে। তাই এই গেইটটির কারণে আমরা ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত।’

মালগাজী গ্রামের সৌল দাস বলেন, ‘আমাদের বিলের অবস্থা খুব খারাপ। খালের জোয়ারের পানি আমরা পাই না। মেশিন দিয়ে পানি দিয়ে জমিতে ধান চাষ করতে হচ্ছে। গেইটটি খুলে দিলে জোয়ারের পানিতে আমরা ফসল ফলাতে পারতাম।’

একই গ্রামের হাসি মণ্ডল বলেন, ‘গেইটের কারণে জোয়ারের পানি আমাদের জমিতে উঠছে না, ঘেরে মাছ হচ্ছে না। আমরা নিঃস্ব হয়ে গেছি। আমাদের নিবেদন, আমরা যেন গেইটি খোলা পাই, তাহলে আমরা ধান ও মাছ চাষ করতে পারব। গত বছরও আমরা কোনো ধান পাইনি, এ বছরও অনেক কষ্ট করে ধান লাগিয়েছি। গেইট এভাবে বন্ধ থাকলে আমাদের মরা ছাড়া কোনো পথ থাকবে না।’

মালগাজী গ্রামের সাবেক ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য উর্মিলা মণ্ডল অশ্রুসিক্ত চোখে বলেন, ‘আমরা এখন জীবিকা নির্বাহ করতে পারছি না। গেইটটি খুলে রাখলে আমরা জোয়ার ভাটার পানিতে ধান ও মাছ দুটিই পেতাম। আমরা জনগণ এখন আর বাঁচতে পারছি না। শুধু পানির হাহাকার। কিভাবে আমরা বাঁচব।’

মালগাজী এলাকার সাবেক মেম্বার রেজি সরকার বলেন, ‘বিগত আট-দশ বছর আগে কাইনমারী খালের উপর স্লুইস করার সময় কথা ছিল গেইট খোলা থাকবে। গেইটটি করা হয় বন্যার পানি ঠেকানোর জন্য। তবে এখন গেইটটি বন্ধ রাখায় ধান ও মাছ কিছুই করা যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি অচিরেই আমাদের এ সমস্যা সমাধানের জন্য।’

ক্ষতিগ্রস্ত রবাট সরকার বলেন, ‘যখন গেইটটি করেছে তখন বলেছে এই জমিতে তিন-চার ফসল হবে। এখন গেইট খোলে না। পানির অভাবে এ এলাকা এখন মরুভূমি হয়ে গেছে। আমাদের খাওয়ার ফসল হচ্ছে না, গরু-মহিষ তাও শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমাদের হাজার হাজার একর জমি ফসল হারাচ্ছে। জমি দিয়ে আয় না থাকায় জমির মালিকেরা ঠিকমত খাজনাও দিতে পারছি না। খাজনার জন্য বারবার তাগিদ দেওয়া হচ্ছে, কীভাবে দেব, খেতেই তো পারছি না।’

কৃষক বাপ্পা বলেন, ‘বর্ষায় কিছু ধান চাষ করেছি। এখন পানির অভাবে সব মরে যাচ্ছে। বাঁচার কোনো উপায় নেই। গেইট না খুললে পানি পাবো কোথায়, রোদে সব মারা যাচ্ছে। পানির অভাবে কেউ কেউ ধান রোপন করতে পারেনি। কোনো জায়গা পানি নেই।

এ বিষয়ে পৌরসভার মেয়র শেখ আব্দুর রহমান বলেন, ‘স্লুইস গেইটটি সব সময় খোলা রাখা হয়। মূলত পলি পড়ে খাল ও জমি উঁচু হয়ে যাওয়ার কারণে জোয়ারের পানি উঠছে না। খালটি সংস্কারের জন্য একটি প্রজেক্ট হাতে নেওয়া হয়েছে। আশা করছি এটি বাস্তবায়ন হলে পানির সমস্যা থাকবে না।’

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কমলেশ মজুমদার বলেন, ‘এ নিয়ে প্রথমে যখন আমার কাছে অভিযোগ আসে তখন আমি সঙ্গে সঙ্গে সেটি পৌরসভার কর্তৃপক্ষকে বলি। তখন গেইট খুলে দিয়ে পানির ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তবে এটির স্থায়ী সমাধানের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড ও পৌরসভার কর্তৃপক্ষের কিছু কাজ করতে হবে। স্থানীয়রা যাতে মাছ ও ধান চাষ করতে পারে তার সুব্যবস্থা করা হবে। জোয়ারের সময় যেন পৌর কর্তৃপক্ষ গেইটটি খোলা রাখে সেই ব্যবস্থা নিচ্ছি।