৭ মার্চের ভাষণ সংরক্ষণের প্রকল্প শিগগির সম্পন্ন হবে
১৯৭১ সালের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যে স্থানটিতে দাঁড়িয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন, সে স্থানসহ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঐতিহাসিক সাতটি স্থান ও সংরক্ষণ করা হচ্ছে। খুব শিগগির ২৬৫ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হবে।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ-তৃতীয় পর্যায় নামের প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে মক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, গণপূর্ত অধিদপ্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ ও মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনার স্থান সংরক্ষণ করা হবে বলে জানানো হয়েছে।
৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের স্থানটি সংরক্ষণের অন্যতম উদ্যোক্তা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘৭ মার্চের ভাষণে বাঙালির মুক্তির সনদ নিহিত। তোমাদের যার যা আছে তা নিয়ে প্রস্তুত থাক—এ ভাষণ শুনেই বাঙালি জাতি সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিতে থাকে। ৭ মার্চ সমগ্র বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলে দেশকে স্বাধীন করার মূলমন্ত্র ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু।’
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আরো বলেন, ‘৭ মার্চের ভাষণ এখন শুধু বাংলাদেশের মানুষেরই সম্পদ নয়, গোটা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের এক অনবদ্য দলিল এটি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর।বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য’র অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেসকো। এ কারণেই আমরা এ স্থানটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছি। এখানে বঙ্গবন্ধুর একটি ম্যুরাল স্থাপন করা হবে। এর কাজ এখন এগিয়ে চলছে। নির্মাণকাজ শেষ হলে সর্ব-সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।’
গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে,সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ,১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ভাষণ, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের স্থানগুলো সংরক্ষণ করা হবে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ ইউনেসকোর ইন্টারন্যাশনাল মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টারে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যের স্বীকৃতি লাভ করায় ভাষণ দেওয়ার স্থানটি সংরক্ষণে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।’
এ প্রকল্পে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ২৩৮ কোটি ১৬২ লাখ টাকা। এ প্রকল্পের অধীনে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, ১৬ ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ভাষণের স্থানগুলোতে ভাষ্কর্য নির্মাণ, স্বাধীনতা টাওয়ার প্লাজার রেনোভেশন, জনসভার মঞ্চ, ক্যাফেটেরিয়া, বসার বেঞ্চ, শিশুপার্কের দেয়ালে ম্যুরাল স্থাপন, বিভিন্ন ধরনের ১৩টি রাইড স্থাপন ও জলাধার নির্মাণ করা হবে।
ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে, যেটি বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের স্থান এবং একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের স্থান সংরক্ষণের নির্দেশনা চেয়ে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার কে এম সফিউল্লাহ ও অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন জনস্বার্থে ২০০৯ সালের ২৫ জুন হাইকোর্টে রিট করেছিলেন। এরপর ২০১০ সালে রিটের ওপর রুলের শুনানি শেষে রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট।
রায়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের একাত্তর-পরবর্তী স্থাপনা, যেমন শিশু পার্ক, শাহবাগ থানা, ফুলের মার্কেট সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
আদালত রায়ে এক বা একাধিক কমিটি গঠন করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঐতিহাসিক স্থান চিহ্নিত করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এগুলো হলো- ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দেওয়া ভাষণের স্থান, ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের স্থান, একাত্তরের ৩ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ থেকে জাতীয় ও প্রাদেশিক সংসদে নির্বাচিত সদস্যদের শপথের স্থান, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের স্থান, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের স্থান, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের স্থান এবং ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ভাষণের স্থান। এই সাতটি স্থান ছাড়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সব ধরনের স্থাপনা অপসারণ করতে বলা হয়েছিল রায়ে। এ বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কাছে আদালতের আদেশ বাস্তবায়নের প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছিল। হাইকোর্টের রায় ঘোষণার পর সরকার প্রকল্প হাতে নেয়। এ প্রকল্প চলাকালীন সম্পূরক একটি আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট আরও একটি রায় ঘোষণা করেন।
রায়ে ঐতিহাসিক ৭ মার্চকে জাতীয় ঐতিহাসিক দিবস ঘোষণার নির্দেশনা চাওয়া হয়। এ বিষয়ে ২০১৭ সালে সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক বশির আহমেদের রিট করেন। পরে ৭ মার্চকে ‘জাতীয় ঐতিহাসিক দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশের নির্দেশ দেওয়া হয়। একইসঙ্গে সারা দেশের জেলা-উপজেলা পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর তর্জনী উঁচু করা ম্যুরাল নির্মাণ করা হয়। এই মুজিববর্ষের মধ্যেই দেশের সব জেলা-উপজেলায় বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল স্থাপনের নির্দেশ দেওয়া হয়।