৭ মার্চের ভিডিও : ‘পালিয়ে’ ভারত যাওয়া, স্বাধীন দেশে ফেরা
প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস বয়ে নেওয়া বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ভিডিও ধারণ করা হয়েছিল পাকিস্তান সরকারের ক্যামেরায়। অনেকের চোখ ফাঁকি দিয়ে তা ডেভেলপের পর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রক্ষা করা হয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরে কর্মরত কয়েকজন মুক্তিকামী বাঙালির বীরত্বে রক্ষা পেয়েছিল বাঙালির ইতিহাসের এই অমূল্য সম্পদ। ভাষণের মাস খানেকের মাথায় সেটা সচিবালয় থেকে লুকিয়ে নেওয়া হয়েছিল ঢাকা জেলার দোহারের একটি বাড়িতে। সেখানে ধানের গোলায় মাসখানেক লুকিয়ে রাখার পর নিয়ে যাওয়া হয় ভারতে। নয় মাসের যুদ্ধ শেষে ভিডিও টেপটিও ফিরে আসে স্বাধীন বাংলাদেশে।
পাকিস্তানি সেনাদের চোখ গলে সচিবালয় থেকে ঢাকার দোহারে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের টেপগুলো নিয়েছিলেন আমজাদ আলী খন্দকার, যিনি সেই সময় ছিলেন চলচ্চিত্র বিভাগের ক্যামেরা সহকারী। সেদিন তাঁর বিচক্ষণতায় রক্ষা পায় জাতির স্বাধীনতা যুদ্ধের অনুপ্রেরণার মূল এ অস্ত্র। বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণের ৫০তম বার্ষিকীতে এসে এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে ভাষণের ভিডিও ধারণ এবং সংরক্ষণ করতে গিয়ে জীবনবাজির গল্প শুনিয়েছেন আমজাদ আলী। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন এনটিভি অনলাইনের স্টাফ করেসপনডেন্ট ফখরুল ইসলাম শাহীন।
এনটিভি অনলাইন : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের রেকর্ড কীভাবে করলেন?
আমজাদ আলী খন্দকার : ১৯৬৯ সাল থেকে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড গোপনে ধারণ করে সংরক্ষণ করতেন চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের বাঙালি কর্মীরা। এরই ধারাবাহিকতায় অসহযোগ আন্দোলনের উত্তাল সময়ে ৭ মার্চের ভাষণ রেকর্ড সংরক্ষণের আয়োজন করি। সে সময় চলচ্চিত্র বিভাগের পরিচালক মহিবুর রহমান খানের (অভিনেতা আবুল খায়ের নামেই বেশি পরিচিত) নির্দেশে আমরা ভাষণের ভিডিও ধারণ ও সংরক্ষণ করি।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে স্বাধীনতার ডাক দিয়ে ভাষণ দেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা সেদিন ছিল মিছিলের শহর। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে দলে দলে মানুষ হেঁটে, বাসে-লঞ্চে কিংবা ট্রেনে চেপে রেসকোর্স ময়দানে সমবেত হয়েছিল।
ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে লাখ লাখ মানুষে ভরে উঠেছিল বিশাল ময়দান। মুহুর্মুহু গর্জনে ফেটে পড়ছিলেন বাঁশের লাঠি হাতে সমবেত লাখ লাখ বিক্ষুব্ধ মানুষ। বাতাসে উড়েছিল বাংলার মানচিত্র আঁকা লাল-সূর্যের অসংখ্য পতাকা। এই জনসমুদ্রে দুভাগে বিভক্ত হয়ে ভিডিওচিত্র ধারণের কাজ করেন চলচ্চিত্র বিভাগের কর্মীরা। একদল মূল ভাষণ আর অন্যদল ধারণ করে ময়দানের সার্বিক পরিবেশ।
১৯ মিনিটের সেই ভাষণে বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উত্তাল জনসমুদ্র যখন স্বাধীনতার ঘোষণা শুনতে উদগ্রীব, তখন বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করেন তাঁর চূড়ান্ত নির্দেশনা- ‘তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব- এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশা আল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম- এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’ সেই ভাষণকে ‘বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য’ হিসেবে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে’ যুক্ত করেছে ইউনেস্কো।
এনটিভি অনলাইন : সেদিন ক্যামেরাম্যান হিসেবে আর কে কে ছিলেন?
আমজাদ আলী খন্দকার : সেখানে ছিলেন ক্যামেরাম্যান জেড এম এ মবিন, ক্যামেরাম্যান এম এ রউফ, ক্যামেরা সহকারী আমজাদ আলী খন্দকার, ক্যামেরা সহকারী এস এম তৌহিদ, ক্যামেরা সহকারী সৈয়দ মইনুল আহসান, ক্যামেরা সহকারী জোনায়েদ আলী ও এমএলএসএস খলিলুর রহমান।
আমরা যখন যাই, সকালবেলা থেকে লোকজনে মাঠ পূর্ণ হয়ে গেছে। তার মধ্যে আমরা গিয়ে ক্যামেরা বসালাম। ভাষণ রেকর্ড করার দায়িত্বে ছিলাম আমি ও মবিন সাহেব। রউফ সাহেব ও তৌহিদ ঘুরে ঘুরে শট নিয়েছিলেন। ভাষণ রেকর্ডের পর সেটা সংরক্ষণে উদ্যোগী হন মহিবুর রহমান খানের কর্মীরা। পাকিস্তানিদের চোখ ফাঁকি দিয়ে কীভাবে করা যায়, তা নিয়ে ভাবতে হচ্ছিল তাঁদের।
এনটিভি অনলাইন : ভিডিওটি পাকিস্তানি প্রশাসন ও আর্মির হাত থেকে কীভাবে রক্ষা করলেন?
আমজাদ আলী খন্দকার : ফিল্ম ডেভেলপ করতে গিয়ে ধরা পড়ার আশঙ্কা ছিল। সেই শঙ্কায় ট্যাগ লাইনে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সংশ্লিষ্ট কিছু না লিখে কৌশল নিয়েছিলাম। সেখানে লেখা হলো- ‘সাইক্লোন’। যাতে অন্যরা মনে করেন, ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড় সংশ্লিষ্ট ফিল্ম। তখন বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ফিল্ম অন্য কোথাও থেকে ডেভেলপ করে নিয়ে আসব, সে ব্যবস্থা আমাদের ছিল না। এটি করা হতো এফডিসির ল্যাবে। বঙ্গবন্ধুর নাম দেখলে সেটা নষ্ট করে ফেলবে সেজন্য আমরা কর্মীরা কৌশল করে ‘সাইক্লোন’ চিহ্ন দিয়ে এফডিসি থেকে ডেভেলপ করে নিয়ে আসলাম। ২৫ মার্চ ক্র্যাকডাউনের পর বিভিন্ন অফিস-আদালতের দায়িত্ব নেওয়া শুরু করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। চলচ্চিত্র বিভাগের মুক্তিকামী কর্মীরা ধারণা করলেন, পাকিস্তানি সেনারা যদি হানা দেয় তাহলে এসব ধ্বংস করে দেবে। সে কারণে কীভাবে এগুলো সচিবালয়ের আর্কাইভ থেকে সরানো যায় সেই পরিকল্পনা করলেন বিভাগের প্রধান মহিবুর রহমান।
তখন উনি আমাকে বললেন, ‘আমজাদ... তোমাকে একটা দায়িত্ব দেব।’ আমি বললাম, ‘কী দায়িত্ব স্যার?’ উনি বললেন, ‘তোমাকে এই মুহূর্তে ফিল্মগুলো নিয়ে ঢাকার বাইরে চলে যেতে হবে।’
সেই কথার পর আমাকে একটি ট্রাঙ্ক কিনে নিয়ে আসার জন্য টাকা দেন মহিবুর রহমান স্যার। নির্দেশ পেয়ে সদরঘাট থেকে ৪২ ইঞ্চি মাপের ট্রাঙ্ক কিনে নিয়ে আসি। ট্রাঙ্ক আনার পর মহিবুর রহমান নিজে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, কাজী নজরুল ইসলামের ওপর করা ডকুমেন্টারি ফিল্ম এবং বঙ্গবন্ধুর আরও কিছু ছবি ও ফিল্ম এর মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন।
এরপর মহিবুর রহমান খানকে আমি বললাম, ‘স্যার, আমি একটু আমার বাবার সঙ্গে দেখা করে আসি?’ তিনি বললেন, ‘যাও’। আমার বাবা তখন বিজি প্রেসে চাকরি করতেন। আমি সেখানে গিয়ে বাবাকে বললাম, ‘আমি দুদিনের জন্য ঢাকার বাইরে যাচ্ছি। চিন্তা কইরেন না।’ বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সোজা সচিবালয়ের কার্যালয়েই ফিরে আসি। নিজের বাসায় স্ত্রী ও দুই সন্তান থাকলেও তাদের সঙ্গে দেখা করতে যাইনি। সচিবালয়ে আসার পর রেকর্ড নিয়ে পালানোর পরিকল্পনা আমাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়।
এনটিভি অনলাইন : সচিবালয় থেকে কীভাবে বের হলেন?
আমজাদ আলী খন্দকার : অফিসে যাওয়ার পরে মহিবুর রহমান খান (আবুল খায়ের) সাহেব আমাকে রুমের ভেতর নিয়ে গেলেন। আমাকে রুমের ভেতর নিয়ে বিদায় দিলেন। আমার হাত ধরে বললেন, ‘আমজাদ, আল্লাহ হাফেজ।’ ওনার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। উনি জানতেন, যদি ধরা পড়ি তাহলে আর বাঁচব না। সচিবালয় থেকে বের হতে হবে, কিন্তু বাইরে বিভিন্ন জায়গায় পাকিস্তানি সেনাদের সতর্ক পাহারা ও টহল চলছে। সচিবালয়ে ঢোকার ফটক ‘সেকেন্ড গেইট’ দিয়ে বেরোনোর পরিকল্পনা করা হয়। ওই ফটকের দায়িত্বে থাকা বাঙালি পুলিশ সার্জেন্ট ফরিদও ছিলেন সেই পরিকল্পনায়। বেবিট্যাক্সিতে করে বড় আকারের ট্রাঙ্ক নিয়ে রওনা হই। সংকেত পেয়ে ফটক খুলে দেন ফরিদ। দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ৯ এপ্রিল। সচিবালয়ের টিনশেড থেকে ট্রাঙ্ক নিয়ে বের হয়ে প্রেসক্লাবের সামনে সেনাবাহিনীর সতর্ক প্রহরায় কিছুটা সন্ত্রস্ত্র হলেও লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে থাকি। প্রেসক্লাবের সামনে এসে দেখি, আর্মির জিপ। মেশিনগান নিয়ে জনতার দিকে তাক করে বসে আছে। ওইখান দিয়ে আমার বেবিট্যাক্সি সোজা চলে এলো। কী আছে- বললেই তো আমি শেষ!
এনটিভি অনলাইন : বঙ্গবন্ধুর ভাষণের এ রেকর্ড কোথায় সংরক্ষণ করেন?
আমজাদ আলী খন্দকার : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের পাশ ধরে চানখারপুল থেকে চকবাজার হয়ে সোয়ারিঘাটে পৌঁছে যাই। এর পরের ধাপ নৌকা পারাপারের। সোয়ারিঘাটে যাওয়ার পর কুলিরা দৌড়ায়ে এলো। বলল, ‘স্যার কী এটা?’ আমি বললাম, ‘তাড়াতাড়ি উঠাও।’ নৌকায় উঠাল। নৌকায় করে জিনজিরায় গেলাম। নৌকায় বুড়িগঙ্গা পাড়ি দেওয়ার পর দেখলাম শয়ে শয়ে লোক বাসের অপেক্ষায়। যে যেভাবে পারছে ঢাকা ছাড়ছে।
দেখি, একটা বাস ছাইড়া যাইতেছে। বাসের পেছনে জোরে একটা থাপ্পড় মারলাম। থাপ্পড় দেওয়ার পরে ড্রাইভারটা পেছনের দিকে তাকাল।... বাসের উপরে উঠায়া দিলাম। ভেতরে জায়গা না পেয়ে ট্রাঙ্কের সঙ্গে বাসের ছাদে চড়ে বসলাম। পৌঁছালাম নবাবগঞ্জের বক্সনগরে। বক্সনগর থেকে গন্তব্যে যেতে হবে হাঁটাপথে কিংবা ঘোড়ায়।
ট্রাঙ্কটা ঘোড়ার পিঠে উঠায় দিয়ে ঘোড়াওয়ালা একদিকে ধরল, আমি একদিকে। চার-পাঁচ কিলোমিটার হবে, বা এর বেশি হবে রাস্তা। আমরা হেঁটে চলে গেলাম। জয়পাড়ায় মজিদ দারোগার বাড়িতে। ওই খানে গিয়ে তাদের বাড়িতে ওটা রাখলাম। ওই সময়ে মহিবুর রহমানও পৌঁছে যান সেই এলাকায়। কিন্তু দারোগা বাড়ির অবস্থান থানার কাছাকাছি হওয়ায় সেখান থেকে ট্রাঙ্কটি সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা।
তখন ওখান থেকে চরকুসাই নামে একটা গ্রাম আছে। ওইখানে দুজনের বাড়ি আছে, হাজি দানেশ ও উমেদ খাঁ- দুই ভাই। ওই বাড়িতে উমেদ খাঁর ধানের গোলার ভেতরে ট্রাঙ্ক লুকিয়ে রাখা হয়। ধানের গোলায় মাসখানেক রাখার পর মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় ট্রাঙ্কটি ভারতে নিয়ে যান মহিবুর রহমান। বিজয়ের পর পরই দেশে ফিরিয়ে আনা হয় সেই ভিডিও ফুটেজগুলো। সাদাকালো ওই ভিডিও ভাষণ ২০১৬ সালে রঙিন সংস্করণে রূপান্তরিত করা হয়।
এনটিভি অনলাইন : যুদ্ধপরবর্তী সময়ে কর্মব্যস্ততা সর্ম্পকে আমাদের বলুন?
আমজাদ আলী খন্দকার : ক্যামেরাম্যান হিসেবে ১৯৭৪ সালে পদোন্নতি পেলেও বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আবার বিপদ নেমে আসে। ১৯৭৯ সালে চক্রান্ত করে ফিফথ গ্রেড থেকে ক্লাস থ্রিতে নামানো হয়। তখন আমি আর জয়েন করিনি। ছুটি নিয়ে রইলাম নয় মাস। এরপর টেলিভিশনে জয়েন করলাম। সেখানে গিয়ে ২৬ মাস বেতন পাইলাম না। ডিএফপির ক্যামেরা সহকারী থেকে ক্যামেরাম্যান হয়ে ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে যোগদান করি। সেখান থেকে ২০০৪ সালে বিটিভির কন্ট্রোলার-চিফ ক্যামেরাম্যান হিসেবে অবসরে যাই। কর্মজীবনে কাজ করতে গিয়ে বেশ কয়েকবার আহত হই। আমার শরীরের বাঁ দিকের অংশ আট বছর ধরে পক্ষাঘাতগ্রস্ত।