উচ্চশিক্ষা নিয়েও মলিন দুই পা অচল বর্ণালী

Looks like you've blocked notifications!

এক মাস বয়সে পোলিওতে আক্রান্ত হলে দুটি পা-ই অচল হয়ে যায় বর্ণালী শীলের। কিন্তু অচল হতে দেননি তিনি তাঁর জীবনচলা। সমাজের অন্য শিশুদের মতো চলাচলে সক্ষম না হলেও অদম্য আগ্রহ আর ইচ্ছাশক্তির ওপর ভর করে তিনি পড়াশোনা করেছেন। অর্জন করেছেন দেশের সর্বোচ্চ মাস্টার ডিগ্রি।

তার পরও বর্ণালী থেমে যাননি। মাধ্যমিক শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে নিবন্ধিত হয়েছেন। সম্পন্ন করেছেন ডিপ্লোমা ইন লাইব্রেরিয়ান কোর্স। এত কিছুর পরও একটি চাকরি জোটেনি এখনো তাঁর ভাগ্যে। ফলে তিনি বর্তমানে চরম হতাশায় নিমজ্জিত। রাষ্ট্র, সরকার, সমাজের সম্পদে পরিণত হতে তিনি একটি চাকরির আকুল আবেদন করছেন তিনি।

বর্ণালী শীল ভৈরবের সাদেকপুর ইউনিয়নের সাদেকপুর গ্রামের ধীরেন্দ্র চন্দ্র শীল ও পুষ্প রানীর দুই ছেলে ও ছয় মেয়ের মধ্যে সবার ছোট। শারীরিক প্রতিবন্ধকতার জন্য ব্যক্তিগত জীবনও শুরু করা হয়নি তাঁর। এরই মধ্যে বাবা মারা গেছেন। মাও জীবন-সায়াহ্নে। হিন্দু পারিবারিক আইনে বাবার সম্পত্তিতে মেয়ের কোনো অধিকার না থাকায় ওই সংসারে তিনি বর্তমানে আছেন বোঝা হয়ে।

বর্ণালী তাঁর শারীরিক প্রতিবন্ধকতা পাশ কাটিয়ে স্বাভাবিক মানুষের মতো পড়াশোনা করেছেন। এখন তিনি নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য কিছু করতে চান। সারা দেশের শারীরিক প্রতিবন্ধীদের কাছে দৃষ্টান্ত হতে চান। ইচ্ছাশক্তি প্রবল থাকলে শিক্ষা অর্জনে কোনো বাধা সৃষ্টি হতে পারে না। জীবনযুদ্ধে থেমে যেতে হয় না। আর এর জন্য এখন তাঁর প্রয়োজন একটি সম্মানজনক চাকরি। দয়া বা সহানুভূতি নয়, তিনি তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতায় ভর করে একটি চাকরি চান—সমাজের কাছে, সরকারের কাছে, রাষ্ট্রের কাছে। জানালেন বর্ণালী শীল।

একটি চাকরির আবেদন শুধু যে বর্ণালীর, তা নয়। তাঁর প্রতিবেশী, শিক্ষক ও জনপ্রতিনিধি সবার। তাঁদের অভিমত, বর্ণালীর মতো অদম্য যোদ্ধা যদি শেষ মুহূর্তে এসে জীবনের কাছে হেরে যান, অসংখ্য প্রতিবন্ধী হতাশ হবেন। নিরুৎসাহিত হবেন। তাই বর্ণালীর পাশে সরকার ও রাষ্ট্রের সমর্থন চান এলাকার পল্লী চিকিৎসক সুধীর চন্দ্র সূত্রধর, শিক্ষক মনীন্দ্র চন্দ্র দাস আর ইউপি সদস্য মাসুদ ভূঁইয়াসহ অসংখ্য মানুষ।

মৃত্যুর পর মেয়ের কী গতি হবে, সেটি ভগবান ছাড়া কেউ জানেন না—এ কথা উল্লেখ করে দেশের প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের কাছে একটি চাকরির আবেদন করেছেন বর্ণালীর বৃদ্ধ মা পুষ্প রানী। তিনি আরো জানান, মেয়ের আগ্রহের কারণে অন্য সন্তানদের সহায়তায় তিনি মেয়েকে শিক্ষা গ্রহণ করিয়েছেন। ছয়টি মেয়ের মধ্যে পাঁচ মেয়ের বিয়ে দিলেও বর্ণালীর বিয়ে তিনি দিতে পারেননি। এখন মেয়ের একটি চাকরি জুটলে, সেটিকে অবলম্বন করে জীবনটা কেটে যেতো। হয়তো পরবর্তী জীবনের মোড় ঘুরে অন্য রকমও হতে পারত।

শারীরিক প্রতিবন্ধী হলেও বর্ণালী বেশ মেধাবী। আর সে কারণেই তাঁরা তাঁকে শিক্ষা অর্জনে সহায়তা করেছেন বলে জানান ভাই দিলীপ কুমার শীল। অসম কষ্টে অর্জিত এই শিক্ষা চাকরি না পেলে কোনো কাজেই আসবে না দাবি করে তিনিও বোনের জন্য একটি চাকরির দাবি করেন।

বর্ণালীকে শারীরিক প্রতিবন্ধী নন, একজন সংগ্রামী নারী হিসেবে উল্লেখ করে ভৈরব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দিলরুবা আহমেদ জানান, বর্ণালী তাঁর শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে কাটিয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জন করেছেন। আর এই শিক্ষা অর্জনে তিনি পরিবার ও সমাজের সহায়তা নিয়েছেন। এখন তিনি পরিবার ও সমাজের জন্য কিছু একটা করতে চান। তিনি বলেন, ‘তাঁর এই ভাবনাকে আমরা স্যালুট জানাই। আমরা চেষ্টা করছি, তাঁকে কীভাবে একটা ভালো জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করা যায়। যদি তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করতে আমরা ব্যর্থ হই, তবে সমাজের অন্যান্য স্পেশাল চাইল্ড নিরুৎসাহিতত হবে। আশা করি, আমাদের সবার প্রচেষ্টায় আমাদের বর্ণালী, ভৈরবের বর্ণালী সারা দেশের অনন্য দৃষ্টান্ত হবে।’