নারায়ণগঞ্জের আদালতে আজ যা হলো

Looks like you've blocked notifications!
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুন মামলার অন্যতম প্রধান আসামি র‍্যাব ১১-এর চাকরিচ্যুত অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদকে আজ সোমবার সকালে প্রিজন ভ্যান থেকে নামিয়ে আদালতে হাজির করা হয়। ছবি : ফোকাস বাংলা

নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের দুই মামলায় প্রধান আসামি নূর হোসেন ও র‍্যাবের তিন কর্মকর্তাসহ মোট ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে। আজ সোমবার সকাল সোয়া ১০টার দিকে নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক সৈয়দ এনায়েত হোসেন এ রায় ঘোষণা করেন। 

রায় ঘোষণার আগে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে শুরুতে নারায়ণগঞ্জ কারাগার থেকে ১৮ আসামিকে একটি প্রিজন ভ্যানে করে আদালতে হাজির করা হয়। তাঁদের প্রত্যেককে আদালতের লোহার শিকলের এজলাসে প্রবেশ করিয়ে বন্দি করে রাখা হয়। এরপর পৌনে ১০টার দিকে কাশিমপুর কারাগার থেকে আসামি নূর হোসেন, র‍্যাব ১১-এর চাকরিচ্যুত অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, চাকরিচ্যুত কমান্ডার এম এম রানা, চাকরিচ্যুত মেজর আরিফকে বিশেষ নিরাপত্তার মাধ্যমে আদালতে হাজির করা হয়। এ সময় নূর হোসেনকে অন্য ১৮ আসামির সঙ্গে ওই লোহার শিকলের এজলাসে ঢুকিয়ে বন্দি করে রাখা হয়। কিন্তু তিনজন তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, এম এম রানা, মেজর আরিফকে এজলাসের সামনে দাঁড়ানোর সুযোগ দেওয়া হয়। এ সময় আসামিদের পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও বিভিন্ন বাহিনীর লোকজন ঘিরে রাখে। 

অপরদিকে আসামিরা রায়কে ঘিরে উদ্বিগ্ন ছিলেন। ব্যতিক্রম দেখা যায় নূর হোসেন ও তারেক সাঈদ মোহাম্মদকে। তাঁরা দুজনই রায়ের আগে বেশ প্রাণচঞ্চল ছিলেন। তারেক সাঈদকে প্রিজন ভ্যান থেকে বের করে আদালতে নেওয়ার সময় মুচকি হাসতে দেখা যায়। নূর হোসেনকে এজলাসে বেশ হাসি-খুশি এবং তাঁর আইনজীবী, নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশের সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায়। 

বিচারকক্ষে আইনজীবী, পুলিশ, মামলার বাদীপক্ষের লোকজন ও সংবাদকর্মীরা অপেক্ষায় থাকেন। সুনশান নীরবতা। এ সময় বিচারকের জমাদার বলে ওঠেন, স্যার হাজির......। সঙ্গে সঙ্গে জেলা ও দায়রা জজ আদালত বিচারক সৈয়দ এনায়েত হোসেন এজলাসে বসেন। এ সময় বিচারকক্ষে উপস্থিত সবাই দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করেন। 

সকাল ১০টায় শুরু হয় বিচার কাজ। শুরুতে বিচারক আসামিদের একটি তালিকা সামনে এনে আসামিদের নাম ও শাস্তি পড়া শুরু করেন। শুরুতে প্রধান আসামি নূর হোসেনের ফাঁসির রায় ঘোষণা করেন। এরপর একে একে তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, এম এম রানা, মেজর আরিফসহ ২৬ জনের ফাঁসির রায় ঘোষণা করেন। এরপর নয় আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়ার রায় পড়েন। 

রায়ের পর তিনজন আসামি কান্নায় ভেঙে পড়েন। আসামি নূর হোসেন ও তারেক সাঈদকে কিছুটা উদ্বিগ্ন দেখা যায়। রায় ঘোষণার পরপর আদালতের কক্ষে হৈচৈ শুরু হয়ে যায়। অনেকে রায়ের বিষয়ে পুরোপুরি জানতে কোর্ট অফিসারের সামনে থাকা আইনজীবীদের দ্বারস্থ হতে থাকেন। 

এরপর আসামিদের একে একে এজলাস থেকে বের করে কারাগারের উদ্দেশে রওনা হন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। সবার শেষে এজলাস থেকে বের করা হয় নূর  হোসেন ও তারেক সাঈদ মোহাম্মকে। তাঁদের নিয়ে যাওয়ার পরপর আইনজীবী ও আসামিদের পরিবারের পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া জানানো শুরু হয়। 

নিরাপত্তা 
আলোচিত সাত খুন মামলার রায় উপলক্ষে আজ সকাল থেকেই নারায়ণগঞ্জ আদালত প্রাঙ্গণ ও আশপাশের এলাকায় কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। আদালতে ফটক থেকে শুরু করে এজলাস পর্যন্ত যেতে কয়েক দফা নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতিবন্ধকতা পার হতে হয়। ঢাকার বাইরে কোনো মামলার রায়ের জন্য এমন কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা আগে দেখা যায়নি। বাংলাদেশে শুধু ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধীদের রায়ের সময়ই এ চিত্র দেখা গিয়েছিল।

স্বজনদের উপস্থিতি ও প্রতিক্রিয়া
আলোচিত এ মামলার রায় জানতে নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী, শ্বশুর, ছেলেমেয়ে এবং চন্দন সরকারের পরিবার, তাদের গাড়ি চালকদের পরিবার উপস্থিত হয়। রায়ের পর সন্তোষ প্রকাশ করে তারা দ্রুত রায় কার্যকরের প্রত্যাশা করে।  

গণমাধ্যমকর্মীদের উপস্থিতি 
রায় উপলক্ষে সকাল ৭টা থেকে শত শত সংবাদকর্মী জড়ো হতে থাকেন। সকাল ৮টার পর আদালত প্রাঙ্গণে ভিড় জমে যায় শত শত সংবাদকর্মীর। শুরু হয় টেলিভিশন কর্মীদের সরাসরি সম্প্রচার ও সাক্ষাৎকার নেওয়া। প্রায় প্রতিটি বড় সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিকরা ঢাকা থেকে আসেন। 

আইনজীবীদের ভিড়
রায় উপলক্ষে বাড়তে থাকে আইনজীবীদের অবস্থান। এ সময় বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া জানান। রায় বাস্তবায়নের দাবিতে আইনজীবীরা আদালত চত্বরে মিছিল বের করেন।  

সাধারণ মানুষের উপস্থিতি
রায়কে কেন্দ্র করে নারায়ণগঞ্জের সাধারণ মানুষ আদালতের ফটকে অবস্থান নিতে থাকে। এ সময় ভেতরে প্রবেশ করার চেষ্টা করলেও তাদের প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। রায়ের পর তারা আনন্দ মিছিল করে এবং স্লোগান দিতে থাকে।  

সাত খুন মামলার রায়ের নথি অনুযায়ী এ মামলার মোট ৩৫ আসামির মধ্যে যে ২৬ জন ফাঁসির দণ্ডাদেশ পেয়েছেন তাঁরা হলেন—নূর হোসেন, মো. মিজানুর রহমান দীপু, চাকরিচ্যুত লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, চাকরিচ্যুত মেজর মো. আরিফ হোসেন, চাকরিচ্যুত লেফটেন্যান্ট কমান্ডার এম এম রানা, মো. মোখলেছুর রহমান, মো. মহিউদ্দিন মুন্সী, ল্যান্স নায়েক হিরা মিয়া, সিপাহি আবু তৈয়ব, সেলিম, সানাউল্লাহ সানা, শাহ জাহান, জামাল উদ্দিন, আসাদুজ্জামান নূর, পুর্ণেন্দু বালা, আরওজি আরিফ হোসেন, সৈনিক আল আমিন, তাজুল ইসলাম, সার্জেন্ট এনামুল কবির, বেলাল হোসেন, শিহাব উদ্দিন, মোর্তুজা জামান চার্চিল, আলী মোহাম্মদ, আবুল বাশার, রহম আলী ও এমদাদুল হক।

তাঁদের মধ্যে প্রধান আসামি নূর হোসেন সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর ছিলেন।

এই ২৬ জনের মধ্যে পলাতক রয়েছেন নয়জন। তাঁরা হলেন—মোহাম্মদ মোখলেসুর রহমান, সৈনিক মহিউদ্দিন মুনসী, সৈনিক আল আমিন, সৈনিক তাজুল ইসলাম, সার্জেন্ট এনামুল কবির, নূর হোসেনের সহযোগী সেলিম, সানাউল্লাহ ছানা, ম্যানেজার শাহজাহান ও ম্যানেজার জামাল উদ্দিন।

মামলার বাকি নয় আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়।

মামলার নথি থেকে জানা যায়, চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার ৩৫ আসামির মধ্যে ২৩ জন কারাবন্দি আছেন। এঁদের মধ্যে ২১ জন নিজেদের দোষ স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবাববন্দি দিয়েছেন। এ মামলায় ১০৬ সাক্ষী সাক্ষ্য দেন।

তবে তদন্ত শেষ হওয়ার পর প্রধান আসামি নূর হোসেনকে ভারত থেকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনায় তাঁর ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি নেওয়ার সুযোগ ছিল না। অন্যদিকে তাঁর গাড়িচালক মিজানুর রহমান দীপু জবানবন্দি দিতে রাজি হননি।

ঘটনার বিবরণে জানা যায়, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা লিংক রোডের খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামের পাশ থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (নাসিক) কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, তাঁর সহযোগী সিরাজুল ইসলাম লিটন, মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম ও গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম এবং নারায়ণগঞ্জের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তাঁর গাড়িচালক ইব্রাহিমকে অপহরণ করে র‌্যাব-১১। পরে ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ছয়জনের এবং ১ মে একজনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

এ ঘটনায় নিহত কাউন্সিলর নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি এবং চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল পৃথক দুটি মামলা করেন।

হত্যাকাণ্ডের ১১ মাস পর ২০১৫ সালের ৮ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের আদালতে ৩৫ জনকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মামুনুর রশিদ মণ্ডল।

এরপর বিভিন্ন সময়ে ২২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং পলাতক থাকেন ১৩ জন। এর মধ্যে ২০১৫ সালের ১২ নভেম্বর নূর হোসেনকে ভারত থেকে দেশে ফিরিয়ে আনার পর ১৩ নভেম্বর সাত খুনের দুটি মামলাসহ ১১ মামলায় পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার দেখায়। ফলে গ্রেপ্তারের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৩-এ। সাত খুনের মামলায় হত্যার দায় স্বীকার করে র‌্যাবের ১৭ জনসহ ২২ জন এবং  ঘটনার সাক্ষী হিসেবে র‌্যাব সদস্যসহ ১৭ জন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

কিন্তু পরবর্তী সময়ে অভিযোগপত্র থেকে পাঁচ আসামিকে বাদ দেওয়ায় এবং প্রধান আসামি নূর হোসেনের জবানবন্দি ছাড়া আদালত অভিযোগপত্র আমলে নেওয়ায় ‘নারাজি’ আবেদন করেন সেলিনা ইসলাম বিউটি। আবেদনটি নারায়ণগঞ্জ বিচারিক হাকিম ও জজ  কোর্টে খারিজ হয়ে গেলে বিউটি উচ্চ আদালতে যান।

হাইকোর্টের আদেশে বলা হয়, পুলিশ চাইলে মামলাটির ‘অধিকতর তদন্ত’ করতে পারে এবং ‘হত্যার ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনার’ ধারা যুক্ত করে নতুন করে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে পারে। তবে তদন্তকারী সংস্থা জানায়, তাদের অভিযোগপত্র ‘নির্ভুল ও চমৎকার’।