মানবপাচার : শার্শা থেকে নিখোঁজ ১৩ যুবক

Looks like you've blocked notifications!

সাগরপথে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে রওনা হয়ে আর ফেরেনি যশোরের ১৩ যুবক। শার্শা উপজেলার বিত্তিবারিপোতা, বলিদাদাহ, নারায়ণপুর, পান্তাপাড়া, গঙ্গানন্দপুর, খড়িডাঙ্গা, গয়ড়া ও ঘিবা গ্রামের এই যুবকদের নদীপথে মালয়েশিয়ায় পাঠাতে টেকনাফে নিয়ে যায় দালালচক্র। কিন্তু দুই থেকে তিন বছর পেরিয়ে গেলেও খোঁজ মেলেনি কারো। তাঁরা বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন, পরিবারের কেউ তা জানেন না।

তবে পরিবারের লোকজন আশায় বুক বেঁধেছেন, একদিন নিশ্চয়ই বাড়ি ফিরবেন তাঁরা।

মানবপাচারের এ ঘটনায় সাতজনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতপরিচয় আরো ১৫ জনের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে মামলা করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তার করা হয়েছে চান্দু ও শফিকুল ইসলাম নামের সন্দেহভাজন দুই দালালকে। এ ছাড়া তবি নামের এক মানবপাচারকারীর বাড়ি থেকে ১৩টি পাসপোর্ট জব্দ করেছে পুলিশ।

ভুক্তভোগীরা জানান, স্থানীয় আকবার ও শুকুর আলীর প্রতারণার ফাঁদে পড়ে কোনো অর্থ ছাড়াই বিদেশ পাড়ি দেওয়ার আশায় ঘর ছাড়েন তাঁদের স্বজনরা। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন—বিত্তিবারিপোতা গ্রামের জামাল হোসেন, মোহর আলী, মুনসুর আলী ও নজরুল ইসলাম; নারায়ণপুর গ্রামের তাহাজ্জত হোসেন তানা; বলিদাদহ গ্রামের মোকলেস আলী; শার্শার পান্তাপাড়া গ্রামের ইকলাস হোসেন; গঙ্গানন্দপুর গ্রামের শরিফুল ইসলাম, মেহেদী হাসান, রাসেল হোসেন; বেনাপোলের খড়িডাঙ্গা গ্রামের শাহিন; গয়ড়া গ্রামের নজরুল ও ঘিবা গ্রামের আলামিন। তাঁরা এখন কোথায়, কী অবস্থায় আছেন তা-ও জানেন না কেউ।

দালালদের খপ্পর থেকে পালিয়ে আসা ইকলাস হোসেন জানান, বিদেশে গিয়ে বেশি টাকা আয় করে একটু ভালো থাকার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। কিন্তু এজেন্সির চাহিদা দুই লাখ টাকা পরিশোধ করার সাধ্য ছিল না তাঁর। হঠাৎ একদিন মাত্র ২০ হাজার টাকায় মালয়েশিয়া যাওয়ার সুযোগ আসে। বাকি টাকা সেখানে কাজ করে শোধ করতে হবে। এমন সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি অনেকে।

অনেকে আবার সংসারের সুখের আশায় সহায়-সম্বল, জমি-জিরাত, ফলদ ও বনজ গাছ, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি বিক্রি করে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা দালালের হাতে তুলে দেন। তিনি আরো জানান, যশোর থেকে তাঁদের নেওয়া হয় টেকনাফে।

এখানে হারুন দালালের মাধ্যমে নদীপথে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে রওনা হন তাঁরা। ট্রলার ও জাহাজডুবিতে অনেকের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন আত্মরক্ষায় জাহাজ থেকে ঝাঁপ দিয়ে পালিয়ে আসা ইকলাস হোসেন। এ সময় ইকলাসের সঙ্গে আরো সাতজন পালিয়ে এলেও জাহাজে থাকা ৩৫০ জনের খবর পাওয়া যায়নি।

দালালদের খপ্পরে নিখোঁজ তাহাজ্জত হোসেনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িতে কেউ নেই। বাড়ির পাশের রাস্তায় তাঁর তিন ছেলেমেয়ে খেলা করছে। মা তাঁদের বাড়িতে রেখে মাঠে দিনমজুরির কাজ করতে গেছেন। সাংবাদিক এসেছে শুনে চারদিক থেকে লোকজন আসতে শুরু করেন। সবার মুখে একই কথা, তাহাজ্জতের কোনো খোঁজ কি পাওয়া গেছে? কিছুক্ষণ পর ছুটে আসেন তাহাজ্জত হোসেনের স্ত্রী ও বিধবা মা। মা লতিফুন্নেছা কেঁদে বলেন, ‘আমার ছেলেকে ফেরত এনে দেও বাবা। দুই বছর ধরে আমার ঠিকমতো খাওয়া-ঘুম নেই। কে দেখবে আমাদের? বউমা দিনমজুরের কাজ করে যা আয় করে, তা দিয়ে সংসার চলে না। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনাও সেই থেকে বন্ধ রয়েছে।’

নিখোঁজ আরেক যুবক মুজিবুর রহমানের স্ত্রী ফাহিমা খাতুন বলেন, বাসাবাড়িতে এবং মাঠে কাজ করে তাঁদের সংসার চলছে। স্বামীর খোঁজ তাঁরা আজো পাননি। একই কথা বললেন নিখোঁজ নজরুল ইসলামের স্ত্রী শেফালি বেগম।

তাহাজ্জত হোসেনের পরিবারের মতো নিখোঁজ প্রতিটি পরিবারে এখন চলছে আহাজারি। সংসারের উপার্জনক্ষম মানুষ নিখোঁজ হওয়ায় অভাবের তাড়নায় পথে বসেছে পরিবারগুলো। বন্ধ হয়ে গেছে কয়েকটি পরিবারে সন্তানদের লেখাপড়া। এতদিন দালালদের ভয়ে কেউ মুখ না খুললেও মানবপাচার নিয়ে দেশ-বিদেশে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর সাংবাদিক ও পুলিশের কাছে মুখ খুলেছেন স্বজনরা।

শার্শা সদর ইউনিয়নের সদস্য আবদুল খালেক বলেন, কয়েকবার এ নিয়ে গ্রামে বৈঠক হয়েছে। তবে দালালরা বহাল তবিয়তেই রয়েছে।

শার্শা উপজেলা নির্বাহী অফিসার এ টি এম শরিফুল আলম বলেন, প্রকৃত তথ্য জানা নেই তাঁদের। তবে নিখোঁজ সদস্যদের ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।

শার্শা উপজেলা চেয়ারম্যান সিরাজুল হক মনজু বলেন, ‘পাচার প্রতিরোধে আমরা বিভিন্ন সময় এলাকাবাসীকে সচেতন করে আসছি। কিন্তু তার পরও এসব যুবক দালালদের মিথ্যা প্রলোভনে পড়ায় এ ঘটনা ঘটেছে। নিখোঁজ যুবকদের সন্ধান পেতে আমরা বিভিন্নভাবে যোগাযোগ রক্ষা করছি।’

শার্শা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইনামুল হক জানান, নিখোঁজ পরিবারের কাছ থেকে অভিযোগ পেয়ে পুলিশ বাদী হয়ে গত ২৮ মে সাতজনের নাম উলেখসহ অজ্ঞাতপরিচয় আরো ১৫ জনের বিরদ্ধে মামলা করেছে। চান্দু ও শফিকুল ইসলাম নামের দুই মানবপাচারকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।