‘মিয়ানমারে আরো পাঁচ শতাধিক বাংলাদেশি’

মালয়েশিয়ায় পাঠিয়ে কাজ করার নামে গভীর সাগরে আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায় করেছিল সংঘবদ্ধ মানবপাচারকারীরা। মালয়েশিয়ায় পাঠাতে না পেরে বাংলাদেশে ফিরিয়ে দেওয়ার নামে লাখ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায় করা হয় জিম্মিদের কাছ থেকে। বাংলাদেশে ফিরে আসা অনেকেই জানিয়েছেন এসব কথা। তাঁরা জানান, মিয়ানমারের ক্যাম্পে এখনো আটকা রয়েছে পাঁচ শতাধিক অভিবাসী বাংলাদেশি।
মানবপাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে প্রায় তিন মাস সাগরে ভাসমান ছিল দেশের অসংখ্য কিশোর-তরুণ-যুবক। মানবপাচারকারীরা নানা প্রলোভন দিয়ে সাগরপথে মালয়েশিয়া নিয়ে যাচ্ছিল তাঁদের। কিন্তু থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়া সীমান্তে গণকবর আর বন্দিশিবির আবিষ্কার হওয়ায় শত শত বাংলাদেশি অভিবাসনপ্রত্যাশীকে নিয়ে বেকায়দায় পড়ে পাচারকারীরা। ফলে কোথাও ভিড়তে না পেরে জাহাজভর্তি মানুষকে নিয়ে সাগরেই কাটিয়ে দেয় প্রায় তিন মাস। তাঁদের মধ্য সাগরে জিম্মি করে রেখে মুক্তিপণ আদায় করে নেয় পরিবারগুলোর কাছ থেকে। লাখ লাখ টাকা আদায় করে দেশে ফিরিয়ে দেওয়ার নামে। মুক্তিপণ আদায় করে সাগরে জাহাজ ভাসমান রেখেই পাচারকারীরা সটকে পড়ে। পরে মিয়ানমারের নৌবাহিনী ভাসমান জাহাজসহ উদ্ধার করে এসব মানুষকে।
ফিরে আসা অভিবাসনপ্রত্যাশীরা জানিয়েছেন, মিয়ানমারের দুটি ক্যাম্পে সাগর থেকে উদ্ধার হওয়া আরো পাঁচ শতাধিক বাংলাদেশি আটকা পড়ে আছে। দেশে ফিরে আসার অপেক্ষার প্রহর গুনছেন তাঁরা।
আবদুর রশিদ নামের দেশে ফেরত আসা একজন বললেন, ‘আমাদের আরো এক সপ্তাহ পর ধরা পড়সে যে শিপটা (জাহাজ), সেখানে ৮০০ লোক আছে। এর মধ্যে ৫৫৩ আছে বাঙালি। আর বাদ বাকি ২৪৭ জন, এরা হচ্ছে বার্মার (মিয়ানমার)। বার্মায় ওদের একটা ক্যাম্পে রাখসে, হয়তো জেলও দিতে পারে, ছাড়েও দিতে পারে। ওই সরকারের ব্যাপার।’
মিয়ানমারে আটক ওই ৫৫৩ জন যে বাংলাদেশি, সে ব্যাপারে কীভাবে নিশ্চিত হলেন—তা জানতে চাইলে আবদুর রশিদ আরো বলেন, ‘আমাগোরে বাংলাদেশি তো, এঙ্কা পাশাপাশি আমাদের রুমই। আরো ২০০ জন আমাদের সাথেই রাখছে। ওদের সব হিস্ট্রি শুনছি। একজন লোক মারা গেছে।’
ফেরত আসা লোকজন জানিয়েছেন, কীভাবে তাঁরা মানবপাচারকারীদের ফাঁদে পড়েছিলেন।
বগুড়ার ধুনটের মোহাম্মদ সাগর আলী নামের এক কিশোর জানাল, তার ফাঁদে পা দেওয়ার গল্প। তার ভাষায়, ‘আমি বাড়িতে কাজ করতাম, অটো গাড়ি চালাতাম। দালালে প্রায় দিন বলত যে তুমি মালয়েশিয়া যাও। বাড়িতে আর এত কষ্ট করো না। ছোট মানুষ মালয়েশিয়া যাও। আমি বলতাম, আমাদের টাকাপয়সা নাই। তো, দালাল হঠাৎ করে একদিন বলল যে, তোমাদের গ্রাম থেকে চারজন যাচ্ছে। তুমি ওদের সাথে যাও। টাকা লাগবে না। কামাই করে দিবা। সে কথা বলার পর আমি বললাম, শিপে কী রকম কষ্ট। বলে, কোনো কষ্ট নাই। শিপে খাওয়া-দাওয়া সবকিছু ভালো। কিন্তু আমাদের যখন চিটাগাং আনল, বারো আউলিয়ার মাজার ঘরের ভেতর যখন বন্দী করে রাখল চার দিন, তখন আমার ভয় ছিল মনে যে আমরা কোন জায়গায় আলাম। জীবন মনে হয় এখন কোনোদিন চলে যায়। তার পরে পাঁচ দিনের মাথায় আমাকে ট্রলারে তুলে দিল। ট্রলারে তোলার পরে শিপে নিয়ে গেল। সেখানে আমাদের খুব কষ্ট। খাওয়া-দাওয়ার খুব কষ্ট।’
ফেরত আসা আরেক কিশোর জানাল, ‘কক্সবাজারে কাজের কথা কইয়া আমাকে লইয়ে আইছে। লইয়া বিক্রি কইরা দিয়া গেছে গা। কাজের কথা কইয়া আনছে, আইনা দুই-চার দিন কাজ করাইয়া কয় আয় তোরারে কক্সবাজারের গাঙ দেহাইয়া আনি। আইনা বিক্রি কইরা দিছে।’
আরেক তরুণ বললেন জাহাজে অবর্ণনীয় কষ্টের কথা। তিনি বলেন, ‘দালালরা আমাদের চক্রান্তে ফালাইয়া নিয়া গেছে। এরা শিপের মধ্যে বলছে ফুটবল খেলার মাঠ আছে। অনেক কিছুই বলছে। নিয়া গেছে। নিয়া আমাগোরে অনেক কষ্ট দিছে। পোড়া মরিচ দিয়া এতটুকু করে ভাত দিছে। প্রায় দুই-আড়াই মাস শিপের মধ্যে রইছিলাম সমুদ্রের মধ্যে। মারধর করছে বহুত। আমরা অনেক কষ্ট পাইছি। পাইপ দিয়া বাইড়াইছে পিডে মিডে।’
গত ৮ ও ১৯ জুন দুই পর্যায়ে কক্সবাজারের ঘুমধুম সীমান্ত দিয়ে ১৮৭ বাংলাদেশিকে ফিরিয়ে আনা হয়। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) এবং বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সহযোগিতায় এসব মানুষকে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় স্বজনদের কাছে ফিরিয়ে দেয় বিজিবি এবং কক্সবাজারের জেলা ও পুলিশ প্রশাসন। ফিরে আসা এসব মানুষকে পাচারের অভিযোগে দেশের সংশ্লিষ্ট থানায় পাচারকারীদের আসামি করে মামলা করা হয়েছে।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তোফায়েল আহমদ বলেন, ‘দালাল যারা আছে, দালালদের নাম আমরা পেয়েছি। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে যে নামগুলা আসছে, তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট থানায় আমরা কপি পাঠাব। তাদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু হবে। সাতটা জেলাতেই মামলা রুজু হবে।’
পুলিশ জানিয়েছে, এরই মধ্যে অনেক মানবপাচারকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রাখা হবে বলে জানিয়েছেন পুলিশের কর্মকর্তারা।