৭৬০ টন সার গেল কই?

Looks like you've blocked notifications!
পুরোনো ছবি

ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলায় বাংলাদেশ রসায়ন শিল্প সংস্থার (বিসিআইসি) বাফার গুদামের ৭৬০ টন সারের হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। বিষয়গুলো খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও এখনো পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি।     

২০০৯ সালে ২১৩ টন ও ২০১০-২০১৬ সাল পর্যন্ত ৫৪৭ দশমিক ৪৯ টন ইউরিয়া সার আত্মসাতের ঘটনা ঘটে। যার দাম আন্তর্জাতিক বাজার অনুযায়ী (প্রতি টন ২৬ হাজার টাকা হিসেবে) এক কোটি ৯৭ লাখ ৬০ হাজার টাকা।  
  
বিসিআইসির পক্ষে কালীগঞ্জ বাফার সার গুদামের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (বদলির আদেশপ্রাপ্ত) মাসুদ রানা বলেন, তাঁর দায়িত্ব নেওয়ার আগে ২০১৬ সালের ১৮ মে বিসিআইসির অতিরিক্ত প্রধান ব্যবস্থাপক (বিপণন) মঞ্জুর রেজার নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি তদন্ত দল গুদামে মজুদ ইউরিয়া সার বাস্তবগণনা ও ওজন করেন। ওই সময় গুদামে ৫৪৭ দশমিক ৪৯ টন ইউরিয়া সার কম পাওয়া যায়। 

ওই কর্মকর্তা বলেন, ২০১০ থেকে ২০১৬ সালের জুন মাস পর্যন্ত গুদাম থেকে ওই সার আত্মসাৎ করা হয়। ওই সময়ে জালাল উদ্দীন গুদামের দায়িত্বে ছিলেন (বর্তমানে যমুনা সার কারখানায় উপপ্রধান প্রকেৌশলী হিসেবে কর্মরত)। তাঁর স্থলে বদলি হয়ে যান আবু সাইদ। কিন্তু গুদামের হিসাব বুঝিয়ে না দেওয়ার কারণে তাঁরা দুজনেই সেখানে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। তাঁদের একজন খাতাকলমে দায়িত্ব পালন করেন আর আরেকজন দায়িত্ব গ্রহণ না করেই গেটপাশে স্বাক্ষর করতেন এবং বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন।  

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০১০-২০১৬ সাল পর্যন্ত ৫৪৭ দশমিক ৪৯ টন সার আত্মসাতের ঘটনায় গত বছরের ডিসেম্বরে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। বিসিআইসির প্রধান কার্যালয়ের নিরীক্ষণ বিভাগের একটি কমিটি সার আত্মসাতের ঘটনায় কারা জড়িত, তা বের করতে কাজ শুরু করে। এখনো তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়নি।  

সার আত্মসাতের অভিযোগ অস্বীকার করে বিআইসির পক্ষে কালীগঞ্জ বাফার সার গুদামের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাবেক কর্মকর্তা জালাল উদ্দীন বলেন, তিনি দায়িত্বে থাকার সময় কালীগঞ্জ বাফার ধারণক্ষমতার চেয়ে ১৭ থেকে ১৮ হাজার টন সার খোলা আকাশের নিচে রাখা হয়েছিল। তখন বর্ষার পানি ঢুকে শত শত বস্তা ইউরিয়া সার নষ্ট হয়ে যায়। এমনকি কোনো কোনো বস্তা খালি হয়ে যায়।  গত ১১ ফেব্রুয়ারি বিসিআইসির প্রধান কার্যালয়ের তদন্ত কমিটির সামনে হাজির তিনি এ বিষয়ে লিখিতভাবে জানিয়েছেন।   

ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘আমি কোনো দিন এক বস্তা সার আত্মসাৎ করিনি। তবে আমার দায়িত্ব পালনের সময়ে হিসাবরক্ষক ফজর আলী ১০-১২ হাজার খালি সারের বস্তা চার-পাঁচ টাকা দরে বিক্রি করেছেন। গত ফেব্রুয়ারিতে বিসিআইসির নিরীক্ষণ বিভাগের তদন্তের সময় তিনি এসব স্বীকার করেন।’  

এ ছাড়া ২০০৯ সালের দিকে ২১৩ টন সার আত্মসাতের ঘটনার তদন্তে গুদামের সে সময়কার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। 

বিসিআইসির সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সরকারি হিসাব অনুযায়ী ওই কর্মকর্তার আত্মসাৎ হওয়া সারের ক্রয়মূল্য (প্রতি টন ৩৪ হাজার টাকা হিসেবে) ৭২ লাখ ৪২ হাজার টাকা। সার আত্মসাতের ঘটনায় জড়িত হওয়ার ঘটনা প্রমাণিত হওয়ার পরও ওই কর্মকর্তাকে চাকরিতে বহাল রাখা হয়েছে। তবে শাস্তি হিসেবে তাঁর বেতন থেকে টাকা কাটা হচ্ছে।  

জমাটবাঁধা সার ক্রাশিংয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ডিলাররা
বিসিআইসির ডিলার সমিতির জেলা সভাপতি হাজি জাহাঙ্গীর হোসেন ও সহসভাপতি অনোয়ারুল ইসলামের অভিযোগ, পাথরের মতো শক্ত জমাটবাঁধা সার ক্রাশিং করা হচ্ছে। এ সার মানসম্মত না হওয়ায় কৃষকরা নিতে চাইছেন না। ক্রাশিংয়ের কারণে সার পাউডারে পরিণত হচ্ছে, যা জোর করে ডিলারদের কাছে দেওয়া হচ্ছে। এতে করে কৃষক ও সার ব্যবসায়ীরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত  হচ্ছেন।  

এ বিষয়ে বাফার গুদামের নরসিংদীর ঘোড়াশাল সার কারখানার জিএম (বিপণন) হাবিবুর রহমান বলেন, জমাটবাঁধা সার ক্রাশিং করে নতুন বস্তায় ভরা হচ্ছে। এ কাজের জন্য গুদামের কর্মকর্তা মাসুদ রানাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ক্রাশিংয়ের পরও সারের গুণগত মান ঠিক থাকবে।  

তবে কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, জমাটবাঁধা সারের গুণাগুণ নষ্ট হয়ে গেছে। এ সার ব্যবহারে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
তবে গুদাম কর্মকর্তা মাসুদ রানা বলেন, জমাটবাঁধা সারের মধ্যে ৩০ হাজার বস্তা মেশিনে ক্রাশিং করা হচ্ছে। এ সারের সঙ্গে ভাল সার মিশিয়ে নতুন বস্তায় ভরে ব্যবহার যোগ্য করে তোলা হচ্ছে।

কম পড়তে পারে ২০০ টন সার
ক্রাশিং করার কারণে ওজনসহ বাস্তব গণনা করা হলে গুদামের অন্তত ১৫০ থেকে ২০০ টন সার ঘাটতি পড়তে পারে। এ ঘাটতির জন্য  প্রাথমিকভাবে গুদামের সাবেক কর্তকর্তা জালাল উদ্দীনসহ সংশ্লিষ্টরা দায়ী বলে দাবি করেছেন মাসুদ রানা। 

চার সদস্যের কমিটি গঠন  
গুদামের বর্তমান কর্মকর্তা মাসুদ রানাকে গত ২২ নভেম্বর বদলি করা হয়েছে। তার স্থানে দুই মাস আগে পেয়েছেন যশোর বাফার গুদামের আখতার হোসেন। তবে গুদামে সারের হিসাব না পাওয়ায় তিনি এখন দায়িত্ব বুঝে নেননি। তাই দুই কর্মকর্তাই সেখানে রয়েছেন।  

গুদামের সারের হিসাব করতে গত সপ্তাহে বিসিআইসির প্রধান কার্যালয় থেকে এ কমিটি গঠন করা হয়। ঝিনাইদহের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রধান করে করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা হলেন কালীগঞ্জ কৃষি কর্মকর্তা, বিসিআইসির ব্যবস্থাপক (বিপণন) ও বিসিআইসির নিরীক্ষা দলের (অডিট টিম) একজন। আগামী ৩১ মের মধ্যে গুদামের সারের ওজনসহ বাস্তব গণনার জন্য চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

এ বিষয়ে অতিরিক্ত জেলা হাকিম আছাদুজ্জামান বলেন, ‘চিঠি পেয়েছি। তবে এখনো কার্যক্রম শুরু করা হয়নি। শিগগিরি তদন্তকাজ শুরু করা হবে।