দখল হয়ে যাচ্ছে নিঝুম দ্বীপ

Looks like you've blocked notifications!

প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার নিঝুম দ্বীপ। এখানে রয়েছে অপরূপ সবুজ বনানী কেওড়া, বাইন, গেওয়াসহ নানা প্রজাতির সারি সারি বৃক্ষ। দ্বীপজুড়ে বিচিত্র রকমের পাখির কল-কাকলি। তারই মাঝে ঝাঁকে ঝাঁকে মায়াবী চিত্রা হরিণের অবাধ বিচরণ, পাশে বিশাল সমুদ্রসৈকত এরই মধ্যে পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্র হয়ে দেশ-বিদেশে খ্যাতি অর্জন করেছে। কিন্তু বনদস্যু ও ভূমিদস্যুদের কবলে পড়ে অপার সৌন্দর্যের এই নিঝুম দ্বীপ তার অস্তিত্ব হারাতে বসেছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৭ সালের ৩০ জুন নিঝুম দ্বীপে এসে দ্বীপটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় একে জাতীয় উদ্যানের ঘোষণা দেন। ২০০১ সালের ২৬ জুলাই ওই ঘোষণা অনুযায়ী প্রায় ৪০ হাজার ৩৯০ একর জমি উদ্যানের অন্তর্ভুক্ত ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করা হয়। এরপর ২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বর আরেকটি গেজেটের মাধ্যমে একে সংরক্ষিত বনভূমির অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর মধ্যেই ২০০৮ সালের আগস্ট মাসে নিঝুম দ্বীপকে নতুন ইউনিয়ন হিসেবে ঘোষণা করা হয়। চরওসমান, চরকমলা, চর-আফতাব মিলে নিঝুম দ্বীপের জায়গার পরিমাণ প্রায় ২০ হাজার একর। ওই ঘোষণার পরপরই স্থানীয় প্রশাসন নিঝুম দ্বীপের সংরক্ষিত বনের জমি বন্দোবস্ত দিতে শুরু করে। ওই সময়ই নিঝুম দ্বীপ ইউনিয়নের রাস্তার চর, দমার চর, কালাম চর, চরমিজান, চরমাহিদসহ  সংরক্ষিত বন ও জাতীয় উদ্যানের অনেক বনভূমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়ে যায়। বন বিভাগের অভিযোগ, সংরক্ষিত বন ও জাতীয় উদ্যানের আওতাভুক্ত জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে।

নিঝুমদ্বীপের আরেকটি প্রচলিত সমস্যা গাছ কেটে অবৈধভাবে ভূমি দখল। এর ফলে প্রায় ৬৩ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ দ্বীপে বনভূমির পরিমাণ দিন দিন কমে যাচ্ছে। বন বিভাগের সূত্রমতে, চলতি দশকের শুরুর দিকেও দ্বীপের তিন-চতুর্থাংশ জুড়ে ছিল ম্যানগ্রোভ বনভূমি। অবাধে গাছ কাটা আর ভূমিদখলের ফলে গাছের সংখ্যা নেমে এসেছে অর্ধেকে। সরেজমিন দেখা যায়, দ্বীপের ছোঁয়া খালি খালের পশ্চিম পাশ, ডুবাইর খালের মাথায়, বাজার খালের দক্ষিণে এবং বৌবাজারের পশ্চিমে হরিণের আশ্রয়স্থলের হাজার হাজার একর বনভূমি কেটে ফেলা হয়েছে।

সংরক্ষিত ও জাতীয় উদ্যানের বন কারা কাটছে জানতে চাইলে বন বিভাগের স্থানীয় বিট অফিসার হাসান আল তারিক বলেন, ‘প্রকাশ্য দিবালোকে বনদস্যুরা বন কেটে দখল করে। এরপর ওই দখলকৃত জমি প্রতি বিঘা ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করছে।’

হাসান আল তারিক আরো অভিযোগ করেন, নিঝুম দ্বীপের চিহ্নিত বনদস্যু কোরবান আলী ও নুর উদ্দিন এই জমি দখলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আর তাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করছে মোশারফ, শাহরাজ, সোহরাব, রাশেদ, রবিউল, বেলাল, বাইট্টা কাশেম, নুরুল ইসলাম, আশ্রাফ, জয়নাল, ফয়েজ, হকসাব, নাসির, মিরাজ গং। চিহ্নিত এই বনদস্যুদের বিরুদ্ধে থানায় একাধিক মামলা হলেও পুলিশ এদের গ্রেপ্তার করছে না। বিট অফিসার এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘১ জুন বনদস্যুরা আমাকে হত্যার জন্য আটক করে। এরপর পুলিশ আমাকে উদ্ধার করার পর ঘটনায় দায়ী চিহ্নিত ডাকাতসর্দার রাশেদসহ ১৬ জনের নাম উল্লেখ করে পরদিন হাতিয়া থানায় একটি মামলা করি। ওই মামলার নম্বর ০৫/২০১৫। কিন্তু এতদিন পেরিয়ে যাওয়ার পরও পুলিশ এই সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।’

বন বিভাগের জাহাজমারা রেঞ্জের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. দেলওয়ার বলেন, ‘সংরক্ষিত বন কাটার অভিযোগ করে থানায় অনেক অভিযোগ করা হলে পুলিশ কার্যত নিষ্ক্রিয়, আসামি রাস্তায় ঘুরে বেড়ালেও পুলিশ দেখছে না।’

ওসি আরো বলেন, এরই মধ্যে উচ্চ আদালতের নির্দেশে ৭১৪৫/২০১৪ ও ১০৭১৪/২০১৪ নম্বর মামলায় ভূমি বন্দোবস্ত ও গাছ কাটার ওপর দেওয়া নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও তা মানছে না কেউ। স্থানীয় প্রশাসনও রাখছে না কোনো ভূমিকা। এর ফলে বেপরোয়া বনদস্যুরা কাটছে গাছ, দখল করে নিচ্ছে ভূমি।

কোস্টাল সার্কেল বরিশালের বন সংরক্ষক অবনী ভূষণ ঠাকুরের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা মামলা করেছি, বন আইনে পুলিশ বন রক্ষা করতে বাধ্য। এটা জাতীয় সম্পদ। তবে রাজনীতিবিদসহ সমাজের সচেতন সবারই সাহায্য না পেলে একা কি বন রক্ষা করা যায়?’

অবনী ভূষণ ঠাকুর প্রয়োজনে হাইকোর্ট থেকে একটি তদন্ত কমিটির মাধ্যমে তদন্ত করে কারা এ বন ধ্বংস করছে তাদের চিহ্নিত করে আইনুগ ব্যবস্থ গ্রহণের দাবি জানান।

নোয়াখালীর জেলা বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. সানা উল্লাহ পাটওয়ারী  বলেন, ‘নিঝুম দ্বীপে বন বিভাগের পর্যাপ্ত লোকবল না থাকায় সম্প্রতি বনদস্যুদের উৎপাত বেড়ে গেছে। শিগগিরই আমরা ডেপুটেশনে লোকবল বৃদ্ধি করার নির্দেশ দিয়েছি এবং তাঁরা আগ্নেয়াস্ত্রসহ টহলে থাকবেন।’ এ বিষয়ে বন প্রহরীর সঙ্গে পুলিশে সহায়তা চেয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

হাতিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নুরুল হুদা বলেন, ‘আমরা ওই বনদস্যুদের ধরায় জিরো টলারেন্স (শূন্য সহনশীলতা) নিয়ে কাজ করছি। তবে কিছু সমস্যা তো আছেই।’

নুরুল হুদা আরো বলেন, ‘ওনাদেরও (বন বিভাগের কর্মকর্তা ও রক্ষী) তো আর্মস আছে। আর্মসের ব্যবহার না করে শুধু লাঠি নিয়ে বেরুলে কি কাজ হবে?’ তবে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে নোয়াখালীর পুলিশ সুপারকে টেলিফোন করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাতিয়া ভূমি রেকর্ড ও জরিপ কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, হুমকির সম্মুখীন নিঝুম দ্বীপের সংরক্ষিত বন ও  জাতীয় উদ্যান রক্ষায় আসছে ভূমি জরিপ মৌসুমে দিয়ারা ও সেটেলমেন্ট জরিপে বনভূমি ও খাসজমি চিহ্নিত করে ক্ষতিগ্রস্তদের সময়োপযোগী পুনর্বাসন করা হলে এই সমস্যা অনেকটাই নিরসন হবে। এ ছাড়া জরিপ অধিদপ্তরের মাধ্যমে সংরক্ষিত বন ও জাতীয় উদ্যানের সীমানা পুনর্নির্ধারণ করা অত্যন্ত জরুরি বলেও অভিমত দেন তিনি। তাহলেই সংরক্ষিত বন ও জাতীয় উদ্যানের ভূমি বন্দোবস্ত দেওয়া কিংবা বনদস্যুদের সবুজ বেষ্টনী উজাড় রোধ করা অনেকাংশে সম্ভব হবে।