সিডর-আইলার প্রভাব এখনো জমি আর মানুষে

Looks like you've blocked notifications!
সিডর আর আইলার আঘাতে সবকিছু হারিয়ে সাতক্ষীরার সবহারা মানুষ এখন এভাবেই বাস করছে বাঁধের ওপর। ছবি : এনটিভি

জলবায়ু পরিবর্তনকে প্রকৃতির প্রতিশোধ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। সেই প্রতিশোধের একটি ছিল ২০০৭ সালে আঘাত হানা ঘুর্ণিঝড় সিডর। এরপর অন্যটি আঘাত হানে ২০০৯ সালে আইলা নাম নিয়ে। সেই প্রতিশোধের আগুনে উপকূলীয় জেলাগুলোর প্রায় দুই লাখ হেক্টর কৃষি জমি লবণাক্ত হয়ে পড়ে। টাকার হিসাবে যা কয়েক হাজার কোটি টাকা। সেইসঙ্গে হুমকির মুখে পড়ে যায় বাঁধগুলো।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ২০৩০ সালের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় খাদ্য উৎপাদন কমবে শতকরা ৩০ ভাগ। গবেষণা বলছে, উপকূলীয় এলাকার মানুষের ওপর এর প্রভাব পড়বে বেশি। এতে এমনিতেই দারিদ্র্য সীমার নিচে থাকা মানুষগুলো আরো দরিদ্র হওয়ার আশঙ্কা থাকবে।

সাতক্ষীরার গাবুরা ইউনিয়নের কৃষক, মহা শেখ আলী সরদার শোনালেন কীভাবে ধীরে ধীরে কৃষি জমি নষ্ট হয়।  এক সময় এখানে ধানের জায়গায় মাছের ঘের এলো।  আর এখন কোনোটাই নেই। তিনি বলেন, ‘মাটিতে খুব লবণ। লাগাতি গেলি খুব সমস্যা আর কি। লাগাতি গেলি অনেক কষ্ট পরিশ্রম করতি হয়। যদি কোনো সংস্থা বা সরকার যখন সহযোগিতা করে তখন একটু চেষ্টা হয় তখন হয়।’

তবে আগামী এক দশকে সাগরতলের উচ্চতা এক মিটার বেড়ে যাওয়ার যে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। সে বিপদ থেকে আপাতত মুক্ত বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা।  পানি বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত বলেন, ‘১৮৬০ সালে এটা পরিবর্তিত হওয়া শুরু হলো শিল্পায়নের কারণে।’ একটি গ্রাফচিত্র দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘হঠাৎ করে এটা খুব দ্রুত বাড়বে। কোনো প্রজেকশন বলছে ৬ ডিগ্রি বাড়বে, কোনো প্রজেকশন বলছে দুই ডিগ্রি বাড়বে। বিশ্বব্যাংক বলছে তোমরা চার ডিগ্রির জন্য প্রস্তুত হও, বিজ্ঞানীরা বলছেন যে দুই ডিগ্রি ছাড়িয়ে গেলে লবণাক্ততা এত বাড়বে, বৃষ্টিপাতের তারতম্য এত বেশি হবে যে, এতে পৃথিবীর যে খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া সেটা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে এবং পৃথিবীতে প্রচণ্ড খাদ্যাভাব দেখা দেবে।  মানুষ দেশান্তরী হবে, জীববৈচিত্র্যে পরিবর্তন আসবে।’

ঘূর্ণিঝড়-জ্বলোচ্ছাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বাসিন্দাদের বাঁচানোর জন্য সত্তরের দশকে যে বাঁধ দেওয়া হয়ে ছিল তাও এখন নড়বড়ে। আইলার বিধ্বংসী থাবায় সেটি বেশ কয়েকবার মিশে যায়। তখন থেকেই জলে ভাসা মানুষরা আশ্রয় নেয় নতুন বাঁধের ওপর।  এই বাঁধও ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।  তবু ভয় নেই বাঁধের ওপর সংসার পাতা মানুষগুলোর।

কোনো জায়গা জমি নেই, তাই এই বাঁধই ভরসা বলে জানালেন স্থানীয় কয়েকজন নারী। তাঁরা প্রত্যেকেই জানান, মাথা গোঁজার জন্য আর কোনো জায়গা না থাকায় এই বাঁধই এখন তাঁদের সবকিছু।

স্থানীয় সমাজকর্মী আবদুস সাদী বলেন, ‘আইলার পর থেকে এদের দিকে তাকালেই দেখা যাচ্ছে সেই বাস্তব চিত্র। মূলত ঘরত পাওয়ার দরকার ছিল এদেরই। কিন্তু পাচ্ছে কারা? যাদের জায়গা জমি আছে তারাই পাচ্ছে। সরকার যদি পুনর্বাসন করে এদের করুক। এরা কেন রাস্তায় আছে?’

একের পর এক বাঁধ দেওয়ায় খাস জমিও শেষ। এ ছাড়া বাঁধের জন্য প্রয়োজনীয় মাটি তাও  নেই- বক্তব্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের। শ্যামনগরের পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপসহকারী প্রকৌশলী নিখিল কুমার দত্ত বলেন, ‘উপকূলীয় অঞ্চলের যে বেড়িবাঁধের কোলে কোনো মাটি নেই। আর আমাদের বেড়িবাঁধের পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধিগ্রহণ করা জায়গা কম। আছে কিন্তু পরিমাণে কম। আর এই বাঁধে কাজ করতে গেলে মাটি পাওয়া খুব দুঃসাধ্য। তবুও আমরা চেষ্টা করছি এবং এইভাবে রিং বাঁধ দিয়ে আস্তে আস্তে বড় বাঁধ করে তারপর চেষ্টা করে ঠেকানো যাবে।’

জলবায়ুর এই পরিবর্তনের জন্য দায়ী সেসব ধনী দেশগুলো এখান থেকে যোজন যোজন দূরে। তারপরও এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে রীতিমতো সংগ্রাম করতে হচ্ছে এই এলাকার মানুষদের।