সেই কলেজছাত্রের খণ্ড-বিখণ্ড দেহ মিলল নদীতে!
নরসিংদী সরকারি কলেজের ছাত্র মাহফুজ সরকার হত্যাকাণ্ডের ১৮ দিন পর মাথাবিহীন খণ্ড-বিখণ্ড দেহ উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল বুধবার রাতে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার বাদুয়ারচরের হাড়িধোয়া নদীতে ভাসমান অবস্থায় একটি ট্রলি ব্যাগ থেকে খণ্ডিত দেহ উদ্ধার করে নরসিংদী মডেল থানার পুলিশ।
এদিকে মাহফুজ হত্যা মামলার আসামি শাহাদাৎ হোসেন রাজুকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গতকাল তিনি নরসিংদীর আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। এরপর বিচারকের আদেশে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়।
নিহত মাহফুজ সরকার নরসিংদী শহরের বৌয়াকুর এলাকার আবদুল মান্নান সরকারের ছেলে। তিনি নরসিংদী সরকারি কলেজের বিএ (পাস) দ্বিতীয় বর্ষে পড়তেন এবং কলেজ শাখা ছাত্রদলের সদস্য ছিলেন।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, মাহফুজকে হত্যা করে তাঁর দেহ আট টুকরো করা হয়। তাঁর মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। দুটি পা চার টুকরো ও দুটি হাত দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। দেহের টুকরোগুলো পচে নষ্ট হয়ে গেছে। বুকের পাঁজর বেরিয়ে গেছে, অন্য টুকরোগুলোর মাংস হাড় থেকে গলে খসে গেছে। তবে মাহফুজের মাথাটি খুঁজে পাওয়া যায়নি। মাহফুজের মাথাটি বিচ্ছিন্ন করে অন্য জায়গায় ফেলে দেওয়ার কথা জানিয়েছেন হত্যাকাণ্ডে গ্রেপ্তার হওয়া রাবেয়া ইসলাম রাবু।
পুলিশ ও আদালত-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাবেয়া ইসলাম রাবু আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে স্বীকার করেন, গত ২৬ মে রাতে তিনি মাহফুজকে তাঁর বাড়িতে ডেকে নেন। ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে পূর্বপরিকল্পিতভাবে রাবু তাঁকে জড়িয়ে ধরেন। এ সময় রাবুর ভাগ্নে শাহাদাৎ হোসেন রাজু পেছন দিক থেকে মাহফুজকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। মাহফুজের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর তিনি ও রাজু মিলে মৃতদেহ টুকরো টুকরো করে ঘরে থাকা ডিপ ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখেন। পরের দিন শনিবার ফ্রিজ থেকে খণ্ড-বিখণ্ড দেহ একটি ট্রলি ব্যাগে ঢোকান। এরপর নৌকা ঘাটে গিয়ে একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে ট্রলি ব্যাগভর্তি লাশটি নিয়ে পাশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার মরিচাকান্দি এলাকায় মেঘনা নদীর গভীর পানিতে ফেলে দেন।
এরপর মাহফুজের বাবা, ভাই ও আত্মীয় স্বজনরা মেঘনায় অনেক খুঁজেও লাশ পাননি। গতকাল লোকমুখে জানা যায় যে নরসিংদী শহরসংলগ্ন হাজীপুর ইউনিয়নের বাদুয়ারচর গ্রামের ঈদগাহসংলগ্ন হাড়িধোয়া নদীতে লাশভর্তি একটি ট্রলি ব্যাগ ভাসছে। এ খবর পেয়ে মাহফুজের বড় ভাই অ্যাডভোকেট মোস্তফা সরকার রাসেল পুলিশকে জানান। বিকেলে নরসিংদী থানার পুলিশ স্থানীয় ব্যবসায়ী সুমনের সহযোগিতায় হাড়িধোয়া নদী থেকে মাহফুজের লাশ উদ্ধার করে। পরে পুলিশ লাশের সুরতহাল করে ময়নাতদন্তের জন্য নরসিংদী সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠায়।
রাবেয়া ইসলাম রাবু স্বীকারোক্তিতে মাহফুজের লাশ মেঘনা নদীতে ফেলার কথা বললেও বাদুয়ারচর এলাকাবাসী জানিয়েছে, গত কয়েকদিন থেকেই লাশভর্তি ব্যাগটি ঘটনাস্থলে ভাসছিল। কিন্তু লোকজন ভয়ে কিছু বলেনি। গতকাল ঘটনাক্রমে বিষয়টি পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। পরে সাংবাদিকদের মাধ্যমে ঘটনাটি মাহফুজের পরিবার জানতে পারে। মাহফুজের বড় ভাই রাসেলসহ অন্য আত্মীয়রা থানা পুলিশের সহযোগিতায় লাশ উদ্ধার ও শনাক্ত করেন। মাহফুজের টুকরো করা দেহের সাতটি অংশ ব্যাগের ভেতর পেলেও মাথাটি খুঁজে পাওয়া যায়নি।
পুলিশ জানিয়েছে, রাবেয়া ইসলাম রাবু লাশের মাথাটি অন্য কোনো জায়গায় ফেলে দিয়েছেন। ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিতে লাশ ফেলার সঠিক স্থান ও মাথা কোথায় ফেলেছেন তা সঠিকভাবে বলেননি।
পুলিশ জানিয়েছে, ময়নাতদন্ত শেষে মাহফুজের খণ্ডিত দেহ তাঁর পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। পরে মাহফুজের লাশ গাবতলী গোরস্থানে দাফন করা হয়।
এ বিষয়ে মাহফুজ হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নরসিংদী সদর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) নূরে আলম হোসাইন জানান, লাশের টুকরোগুলো মাহফুজের বলে চিহ্নিত করেছে তাঁর পরিবার। লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের পর কিছু অংশ ডিএনএ পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।
যে কারণে হত্যা
পুলিশ ও নরসিংদী শহরের ইনডেক্স প্লাজার একাধিক দোকান মালিক ও কর্মচারী জানিয়েছেন, মাহফুজ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী ছিলেন। তাঁর নামে থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। তিনি ও তাঁর বন্ধুরা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে প্রায়ই মার্কেটে এসে চাঁদাবাজি করতেন। মাহফুজ রাবুর দোকান থেকে জোর করে কাপড়চোপড় নিয়ে যেতেন। একপর্যায়ে মাহফুজ বন্ধুবান্ধব নিয়ে রাবুর ভাড়া বাসায় গিয়ে উত্ত্যক্ত ও শারীরিকভাবে নির্যাতন-নিপীড়ন করতেন। কিছুদিন আগে মাহফুজ ও তাঁর বন্ধু শাহীন রাবুর ১২ বছর বয়সী ছেলেকে বাড়িতে একা পেয়ে বলাৎকার করেন। এর পর থেকে সন্তানের ওপর নির্যাতনের বিচার ও প্রতিশোধ নিতে ২৬ মে শুক্রবার রাতে মাহফুজকে বাসায় ডেকে আনেন রাবু। পরে ভাগ্নে রাজুকে নিয়ে মাহফুজকে হত্যা করেন।