পাহাড়ধসের আশ্রয়কেন্দ্রে চোখের জলে ভেজা ঈদ আনন্দ
রাঙামাটিতে গত ১৩ জুন পাহাড় ধসে সর্বহারা হয়েছে কয়েকশ পরিবার। নিহত হয়েছে ১২০ জন। বরাবরই সুখ আর দুঃখে ঈদ উদযাপন করতেন এসব নিহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবার নিজেদের মতো করেই। ছিল প্রাপ্তি, পূর্ণতা কিংবা অপূর্ণতাও। এবার তারাই জীবনে প্রথম ঈদ উদযাপন করল আশ্রয়কেন্দ্রে।
সর্বহারা এসব মানুষের কিছুটা দুঃখ, আর তার সঙ্গে কিছুটা আনন্দও মেশানো ছিল এবারের ঈদ। কেমন কাটল তাদের এবারের ঈদ, জানা গেল বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্র ঘুরে।
ঈদকে আনন্দমুখরভাবে উদযাপন করতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিল রাঙামাটি জেলা প্রশাসন। প্রতিটি আশ্রয়কেন্দ্রে ছিল উন্নত মানের খাবার, আয়োজন ছিল বেশ কিছু অনুষ্ঠানের। এ ছাড়া জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রতিটি আশ্রয়কেন্দ্রে বিতরণ করা হয় ঈদের নতুন কাপড়। শুধু মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকরাই নয়, এই নতুন কাপড় পেয়েছে অন্য ধর্মের লোকজনও। ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ এই বার্তাই পৌঁছে দেওয়া হয়েছে সবার কাছে।
সোমবার সকালে ঈদগাহ মাঠে দলবদ্ধভাবে পবিত্র ঈদুল ফিতরের নামাজ শেষ করার পরে আশ্রয়কেন্দ্রে বসবাসরত সবাইকে ঈদের সেমাই ও নুডুলসসহ সুস্বাদু খাবার খাওয়ানো হয়। এরপর দুপুরে ছিল পোলাও, ডিম, মুরগির মাংসসহ বাহারি আয়োজন। একইভাবে বিকেলে ও রাতেও পরিবেশন করা হয় উন্নত মানের খাবার। সবার জন্যই ছিল নতুন জামাকাপড়।
রাঙামাটি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থানরত সাদ্দাম বলেন, ‘আমার ঘরবাড়ি সব কিছু মাটির নিচে চলে গেছে। এখন আমার আর কিছুই নেই। আমি এখন বউ, বাচ্চা নিয়ে এই প্রথম আশ্রয়কেন্দ্রে ঈদ করছি। বাসায় ঈদ করলে একটু ভিন্ন ধরনের অনুভূতি বিরাজ করে। বর্তমানে তেমন কোনো অনুভূতি নেই। তবু সরকার যা দিয়েছে এবং যা করেছে তার জন্য ধন্যবাদ জানাই।’
ভেদভেদী এলাকার আবুল হাসেম বলেন, ‘আমার ছেলেকে হারিয়ে আমি কী ঈদ করব? এই ঈদ আমার জন্য আনন্দের নয় বরং কষ্টের ও যন্ত্রণার। আমি এবার ছেলে নূর মোহাম্মদকে ছাড়া ঈদগাহে গেলাম। এই কষ্ট আমি কীভাবে বুঝাই।’
আবুল হাসেমের সঙ্গে কথা বলার সময় পাশ থেকে নির্বাক নূর মোহাম্মদের মা চিৎকার করে বলেন, ‘নূর, ওরে বাপ নূর, তুই কইরে বাপ......তুই কই...।’
এমন অসংখ্য মায়ের আহাজারিতে ভেজা ছিল সোমবার পবিত্র ঈদের দিন, রাঙামাটির অসংখ্য আশ্রয়কেন্দ্রে। চোখের জলেই ভেজা ছিল ঈদ আনন্দ।
স্বামী সন্তান হারানো জুলেখা খাতুন। তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঈদ আবার কী? আমার জীবনের সব আনন্দ তো কেড়ে নিয়েছে। আমার স্বামী, সন্তান, বাড়িঘর কিছুই নাই, আমি কী করব? আমার যে এখন দাঁড়ানোর কোনো স্থান নাই।’
স্বামী-সন্তান হারানো এই মধ্য বয়সী নারী তাঁর স্মৃতির ঝাঁপি খুলে দিয়ে, বলতে বলতে চোখের জল মুছে নিচ্ছিলেন বারবার, নিজেরই শাড়ির আঁচল দিয়ে। একপর্যায়ে তিনি শাড়ির আঁচল ধরে বলেন, ‘আমার খোকাকে আমি আর পামু না, এর চেয়ে বেদনার কী হতে পারে।’ প্রিয়জন হারানো ঈদের বেদনা যেন এই নারীর চোখে স্পষ্ট দেখা মিলল।
রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মানজারুল মান্নান বলেন, ‘এটা এক অন্য রকম অনুভূতি, ভাষায় বোঝানো মুশকিল। আমার জীবনের সম্ভবত শ্রেষ্ঠ ঈদ উদযাপন করলাম এবার। আমি চেষ্টা করেছি, তাদের কষ্ট ভুলিয়ে ঈদের আনন্দ দিতে, জানি না কতটুকু পেরেছি।’
বাতাসে স্বজনের শরীরের ঘ্রাণ
সারা দেশের মানুষ যখন ঈদে আনন্দ করছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে তখন রাঙামাটির বহু মানুষ বাতাসে খুঁজে বেড়াচ্ছে তাদের প্রিয়জনের লাশের গন্ধ।
যে এলাকাগুলোতে পাহাড় ধস ঘটেছে, সেসব এলাকায় সকালে বহু মানুষের আনাগোনা দেখা যায়। তারা যেন বাতাসে খুঁজে বেড়াচ্ছে তাদেরই প্রিয়জনের শরীরের ঘ্রাণ, সাথে খোঁজার চেষ্টা যেনো বিগত সময়ের স্মৃতি, যা এখন কেবলই দীর্ঘশ্বাস। তার সাথে মিলিয়ে নিচ্ছেন প্রিয় মানুষটার শরীরের প্রিয় গন্ধটুকু। সব মিলিয়ে ঈদের বাতাসে প্রিয় মানুষটার ছোঁয়া পেতে চায় তার স্বজনেরা।
প্রায় সব আশ্রয়কেন্দ্রের চিত্রই ছিল দৃশ্যত একই রকম। কোথাও শোক, কোথাও বেদনা, খানিকটা উচ্ছ্বাসও। তবে শোক বা বেদনার আবহ সবচেয়ে বেশি ছিল রাঙামাটি সরকারি কলেজ, বিএডিসি, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রে। এখানেই যে স্বজন হারানো মানুষের সংখ্যাটা বেশি।
তবু শোক আর বেদনায় কাটল ঈদ। জীবন তার স্বাভাবিক নিয়মেই এগিয়ে যাবে। বেঁচে থাকা আত্মজরা বাতাসে খুঁজে ফিরবে প্রিয়জনের শরীরের ঘ্রাণ, যাদের অনুপস্থিতি কিছুটা হলেও এলোমেলো করে দেবে তাদের স্বাভাবিক জীবন।