গাফফার চৌধুরীর বিরুদ্ধে আদালতে আর্জি
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগ এনে বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলাম লেখক আব্দুল গাফফার চৌধুরীর বিরুদ্ধে আদালতে আর্জি দাখিল করা হয়েছে। আজ মঙ্গলবার আইনজীবী হুমায়ুন কবির উজ্জ্বল খুলনা মহানগর হাকিমের আদালত ‘গ’ অঞ্চলে ওই আর্জি দাখিল করেন।
বিচারক মো. ফারুক ইকবাল আসামির বিরুদ্ধে সমন ইস্যু করা হবে মর্মে আদালতে মৌখিক ঘোষণা দিলেও আদেশ না দিয়েই তিনি আদালত ত্যাগ করেন বলে বাদীপক্ষ জানিয়েছে।
আর্জিতে বাদী অভিযোগ করেন, গত ৩ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনে ‘বাংলাদেশের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত’ শীর্ষক আলোচনায় আব্দুল গফ্ফার চৌধুরী বিষয় বস্তুর বাইরে গিয়ে আল্লাহ, মহানবী হজরত মুহাম্মদ (স.), দাড়ি ও টুপি এবং বোরকা ও হিজাব পরার পবিত্র বিধান সম্পর্কে অবমাননাকর বক্তব্য প্রদান করেন। যা বাদীসহ বিশ্বের দেড় শ কোটি মুসলমানের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছে। এ ঘটনার পর থেকে দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ বিক্ষোভ প্রদর্শন করছেন। এতে দেশব্যাপী অরাজকতা এবং রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশঙ্কা রয়েছে।
এ অবস্থায় আব্দুল গাফফার চৌধুরীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার আবেদন করা হয় আর্জিতে। এতে চারজনকে সাক্ষী করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে বাদীপক্ষে মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী তৌহিদুর রহমান তুষার জানান, আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করেন। আসামির বিরুদ্ধে সমন ইস্যু করা হবে- মর্মে মৌখিক ঘোষণা দিয়ে দুপুর ২টায় আদেশ দেওয়ার কথা বলেন। কিন্তু বিকেল ৪টা পর্যন্ত কোনো আদেশ না দিয়েই তিনি আদালত ত্যাগ করেন।
আবদুল গাফফার চৌধুরী ৬ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের টাইম টিভিকে তাঁর ৩ জুলাইয়ে দেওয়া বক্তব্যের ব্যাখ্যা দেন।
টাইম টিভিকে গাফফার চৌধুরী বলেন, ‘তেসরা জুলাই নিউইয়র্কে আমি যে বক্তব্য দিয়েছি একটি একাডেমিক আলোচনা সভায়। সেটাকে বাংলাদেশের কিছু রাজনৈতিক মৌলবাদী দল রাজনৈতিক পুঁজি করেছে, এবং মিথ্যা প্রচার চালাচ্ছে। তারা বলেছে যে, আমি ধর্মবিরোধী। রসুল, ইসলাম এমনকি আল্লাহর অবমাননা করেছি। কোনো সাধারণ মানুষের আল্লাহকে অবমাননা করার শক্তি আছে- এটা প্রচার করাও ধর্মদ্রোহিতা এবং এই তথাকথিত ইসলামপন্থীরা এটাই প্রচার করছে।’
বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা করা হচ্ছে দাবি করে বিশিষ্ট এই কলামিস্ট বলেন, ‘আমার যাঁরা নিন্দা করছেন তাঁদের কাছে আমার একটাই অনুরোধ, আমার বক্তব্যটা সম্পূর্ণ পড়ুন। তারপর যদি মনে করেন যে আমি ধর্ম, আল্লাহর রসুলের বিরুদ্ধে কিছু বলেছি, তখন তার শাস্তি বিধান করেন। কিন্তু এই বিনা বিচারে কিছু এই এক শ্রেণির মোল্লার উসকানিতে, তাও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে, তাঁরা যা করছেন এটার নিন্দা করার ভাষা আমার জানা নেই। তাঁরা আমাকে ছোট করেননি, তাঁরা ধর্মকে, আল্লাহর রসুলকেই ছোট করছেন।’
আল্লাহর ৯৯ নাম নিয়ে গাফফার চৌধুরী মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন এই সমালোচনার জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি আল্লাহর ৯৯ নাম সম্পর্কে দেবতাদের নাম বলিনি। আমি যেটা বলেছি যে, কালচারাল এসেমিলেশন কীভাবে প্রত্যেকটি সভ্যতা এক সভ্যতা থেকে আরেক সভ্যতা উপকরণ গ্রহণ করে। বাংলা ভাষাকে হিন্দুদের ভাষা বলা হয়। এটা যে সত্য না- এইটা প্রমাণ করার জন্য বলেছিলাম যে, আরবি ভাষাও ছিল এককালে কাফেরদের ভাষা। এইটা বলা কি আরবি ভাষার অবমাননা? তারপরে বলেছি যে আল্লাহর নাম, গুণাত্মক নামগুলো আগে কাফেরদের দেবতাদেরও ছিল। তা না হলে রসুলুল্লাহর পিতার নাম আবদুল্লাহ কী করে হয়? এইটা তো মুসলমান নাম নয়।’
আল্লাহ নামটি সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে গাফফার চোধুরী বলেন, ‘এখানে আল্লাহ আছে। এই আল্লাহ ছিল কাবা শরিফের কাবার অধিষ্ঠিত মূর্তিগুলার ভিতরে প্রধান মূর্তির নাম। অবশ্য কেউ কেউ এটাকে ইলাহ বলে। ইলাহ থেকে আল্লাহ শব্দের উৎপত্তি। এইভাবে আমাদের রসুল আরবের যে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য যেটা ধর্মবিরোধী নয় সেগুলোকে তিনি গ্রহণ করেছেন। এমন কি হজও ইসলামের হজ নয়। এটাও সেই দুই হাজার তিন হাজার বছর আগের কাফেরদের দ্বারা প্রবর্তিত হজ। উনি সেখানে একেশ্বরবাদটাকে যুক্ত করেছেন। এটিই আমি বলেছি যে এটা হচ্ছে একাডেমিক আলোচনা এবং আমি সাহাবাদের সম্পর্কে কোনো কটূক্তিই করি নাই।’
সাহাবীদের নাম ও মুসলমানদের নাম রাখার সংস্কৃতির প্রসঙ্গ টেনে গাফফার চৌধুরী বলেন, ‘আমি বলেছি যে আমরা আরবি ভাষা না জেনে আরবিতে সন্তানদের নামকরণ করি- সেটা ভুল। আমাদের নামটার অর্থটা জানা উচিত।
যেমন- আবু হুরায়রা। এটা রসুলুল্লাহর সাহাবার প্রকৃত নাম নয়। রসুলুল্লাহ তাকে ঠাট্টা করে বিড়ালের বাবা ডাকতেন। এখন আমরা যেহেতু আরবি জানি না। আমরা সেই বিড়ালের বাবার নামটা আমরা রাখি। যার কাশেম বলে কোনো ছেলে নেই, উনি তাঁর নাম রাখেন আবুল কাশেম। এইভাবে আরবি ভাষা না জানার জন্য অনেক বিভ্রান্তি আমাদের দেশে। মোজাক্কার মোয়ান্নাস বুঝতে পারি না আরবের। আমাদের নামে অনেক সময় আমরা স্ত্রী লোকের নাম রাখি। তারও উদাহরণ দিয়েছি।’
রসুল শব্দের অর্থ দূত জানিয়ে আব্দুল গাফফার চৌধুরী টাইমস টেলিভিশনকে বলেন, ‘রসুল শব্দকে মনে করি, রসুল বললেই বুঝি আমাদের রসুলুল্লাহকে বর্ণনা করা হয়। অথচ পণ্ডিত নেহেরু যখন সৌদি আরবে যান তখন তাঁকে বলা হয়েছিল, মারহাবা ইয়া রসুলে সালাম। হে শান্তির দূত তোমাকে সংবর্ধনা জানাই। অথচ বাংলাদেশে গিয়ে কেউ যদি বলে অমুক একজন রসুল মানে অ্যাম্বাসেডর তাকে মুরতাদ বলা হবে। এই যাঁরা আজকে মুরতাদ বলছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে কথা বলছেন এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য আজকে তাঁরা ধর্মকে ব্যবহার করে ধর্মের অবমাননা করছেন। আমি এঁদের শাস্তি চাই।’
বাংলাদেশের একশ্রেণির ধর্ম ব্যবসায়ী যারা যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত তারাই রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির জন্য অপপ্রচার চালাচ্ছে বলে দাবি করেন প্রবাসী এই কলামিস্ট। তিনি বলেন, ‘যারা যুদ্ধাপরাধ করেছে, বাংলাদেশে ৩০ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী, যারা পরবর্তীকালে সব রকম মুক্তবুদ্ধি, মুক্তচিন্তার দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ইসলামের নাম করে ব্যবসা করতেছে, ব্যাংক করেতেছে, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি করতেছে এবং আজকে যারা এই ধর্মকে আবার রাজনৈতিক পুঁজি করেছে তারাই আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। আমি তাদের চাইতে অনেক বড় মুসলমান।’