‘৩০ ফার্মেসিতে দেখিয়েছি কেউ লেখা বুঝতে পারেনি’

Looks like you've blocked notifications!

‘এই যে প্রেসক্রিপশনটা (ব্যবস্থাপত্র) দেখছেন, এটা কলেজ গেটের ৩০টি ফার্মেসিতে দেখিয়েছি, কিন্তু কেউ লেখা বুঝতে পারেনি। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। এখন আবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব ঠিক করে লিখে আনতে।’

এভাবেই একটি প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে নিজের দুর্ভোগের কথা জানালেন ইউনুস আলী। বলেন, এই প্রেসক্রিপশন দেখে কোনো দোকানিই এর পাঠোদ্ধার করতে পারেননি। চিকিৎসক এমনভাবে সেখানে ওষুধের নাম লিখেছেন যে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থাকার পরও এসব দোকানের বিক্রেতারা বুঝতে পারেননি যে আসলে চিকিৎসক কোন ওষুধের নাম লিখেছেন।

প্রেসক্রিপশনটিতে দেখা যায়, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের বহির্বিভাগের টিকেট কেটেছিলেন ইউনুস আলী। সেখানে সমস্যার বর্ণনা দেওয়ার পর প্রেসক্রিপশন লেখেন কর্তব্যরত চিকিৎসক। প্রেসক্রিপশনে দুটি ওষুধের নাম লেখেন তিনি। চিকিৎসকের নামটিও বোঝার উপায় নেই।

প্রায় একই রকম অভিজ্ঞতার কথা জানালেন মিরপুরের বাসিন্দা ইমান শেখ (৩৫)। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকায় দেখা হলে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘সারা দিন একটা প্রেসক্রিপশন নিয়ে ঘুরছি। মিরপুরের কোনো ফার্মেসিই বুঝতে পারেনি। বাধ্য হয়ে ঢাকা মেডিকেলে এলাম প্রেসক্রিপশনটা আবার চিকিৎসককে দেখিয়ে ঠিক করে লিখে নিতে।’

অথচ উচ্চ আদালতের নির্দেশ ছিল স্পষ্ট ভাষায় প্রেসক্রিপশন লেখার ব্যাপারে। সে নির্দেশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে রোগী ও তাঁদের স্বজনদের। অনেক সময় প্রেসক্রিপশন বুঝতে না পেরে ভুল ওষুধ দিচ্ছেন বিক্রেতারা। আবার কখনো বা ওষুধ নেই বলে বিদায় করে দিচ্ছেন ক্রেতাদের।

এমনকি নিজের লেখা প্রেসক্রিপশন পড়ে দেখলে কখনো কখনো নাকি চিকিৎসক নিজেও বুঝতে পারেন না- এমন অভিযোগও পাওয়া গেছে।

রাজধানীর অর্ধশতাধিক ফার্মেসির ওষুধ বিক্রেতা, ক্রেতা ও চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতাল, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় পঙ্গু হাসপাতাল, ল্যাবএইড হাসপাতাল, স্কয়ার হাসপাতাল, আদ দ্বীন মেডিকেল কলেজ, অ্যাপোলো হাসপাতালসহ বেসরকারি আরো কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে রোগী ও তাঁদের স্বজন, ফার্মেসির ওষুধ বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে প্রায় একই ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে।

চিকিৎসকরা কেউ কম শিক্ষিত নন, তারপরও কেন হাইকোর্টের নির্দেশনা উপেক্ষা করে দুর্বোধ্যভাবে প্রেসক্রিপশন লিখছেন সেই প্রশ্ন রাখেন ভুক্তভোগীরা।

অন্যদিকে রাজধানীর মিরপুর-১, ১০, কল্যাণপুর, শ্যামলী, কলেজ গেট এবং রাসেল স্কয়ারের লাজফার্মা, আবেদীন ফার্মা, ওয়াসী ফার্মা, আয়েশা ফার্মেসি, মির ফার্মা, রাসেল ফার্মা, মেডিকাস ফার্মা, গ্রিন লাইফ ফার্মেসি, আল-সামি ড্রাগ হাউস, বাংলাদেশ ফার্মাসহ বেশ কয়েকটি ওষুধের দোকানের বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চিকিৎসকদের লেখার কারণে অনেক সময় প্রেসক্রিপশন বুঝতে তাঁদের সমস্যা হয়। বিশেষ করে এক এলাকার প্রেসক্রিপশন অন্য এলাকার ফার্মেসিতে নিয়ে গেলে বোঝা মুশকিল হয়ে যায়। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে বিক্রেতারা তাঁদের এলাকার হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোর চিকিৎসকদের প্রেসক্রিপশন বেশি বেশি হাতে পান। তাই অন্য এলাকার চিকিৎসকদের প্রেসক্রিপশন বুঝতে তাঁদের সমস্যা হয়।

লাজ ফার্মার প্রধান ফার্মাসিস্ট আল-আমিন তালুকদার বলেন, ‘আমাদের এখানে প্রতিদিন প্রায় তিন হাজার প্রেসক্রিপশন আসে। এর মধ্যে কমপক্ষে তিন থেকে চারশ প্রেসক্রিপশন খুব হিজিবিজি করে লেখা থাকে। এ ছাড়া প্রতিদিন অন্তত পাঁচ থেকে ১০টা প্রেসক্রিপশন একদম বুঝতে না পেরে ফেরত পাঠাতে হয়। বিশেষ করে সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা বেশি হিজিবিজি করে লেখেন।’

ঢাকা মেডিকেল ও শাহবাগ এলাকার রাজবাড়ী ড্রাগ হাউস, চৌধুরী ড্রাগ হাউস, নাজ ফার্মা, ভিআইপি ড্রাগ হাউস, গ্লোবাল ফার্মা, ল্যাবএইড ফার্মেসিসহ বেশ কয়েকটি ফার্মেসির ওষুধ বিক্রেতারা জানান, চিকিৎসকরা আগেও যেমন করে প্রেসক্রিপশন লিখতেন, এখনো তেমন করেই লেখেন। বিশেষ করে ডিব্বা (অনুমোদনহীন ফুড সাপ্লিমেন্ট) আইটেমগুলো বুঝতে বেশি সমস্যা হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) আবদুর রব বলেন,‘অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে হাসপাতালগুলোতে আমরা সঠিকভাবে প্রেসক্রিপশন লেখার নির্দেশনা দিয়েছি। যেহেতু এখনো কোনো পরিবর্তন হয়নি, সেহেতু আমরা আবার বোর্ড মিটিংয়ে এ বিষয়টি নিয়ে কথা বলব।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পলিচালক (অর্থ) খাজা আবদুল গফুর জানান, ‘ইউনিট কনসেপ্টকে কাজে লাগাতে হবে। ইউনিটের প্রধান সঠিক করে লিখবেন এবং তাঁর সহকর্মীদেরকেও সুন্দর করে লিখতে পরামর্শ দেবেন। এভাবে যদি এখান থেকে বের হয়ে আসা যায়।’

বিষয়টি সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান বলেন, ‘হাইকোর্ট যখন প্রেসক্রিপশন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন, তখন এ বিষয়ে আমরা অনেক আলোচনা করেছিলাম। কিন্তু পুনরায় অভিযোগ না আসায় পরে আমরা আর সেভাবে ফলোআপ করিনি। আসলে রোগীর চাপ বেশি হওয়ায় চিকিৎসকদের তাড়া থাকে। যার ফলে প্রেসক্রিপশন ভালো বা খারাপ হচ্ছে সেদিকে খুব বেশি নজর থাকে না।’

দুর্বোধ্য প্রেসক্রিপশন লেখার বিষয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া বলেন, সরকারি হাসপাতালে বিশেষ করে আউটডোর বিভাগে হিজিবিজি প্রেসক্রিপশন জটিলতা এড়ানো বেশ কঠিন কাজ। রোগীর সংখ্যা অনেক। কিন্তু চিকিৎসকের সংখ্যা খুবই কম। এই সমস্যা সমাধান করতে হলে সরকারের উচিত প্রয়োজন মোতাবেক চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়ানো। তাহলেই কেবল এর থেকে পরিত্রাণ সম্ভব, নতুবা নয়।

চিকিৎসকদের এমন দুর্বোধ্য প্রেসক্রিপশন থেকে মুক্তির পথ আছে কি না জানতে চাইলে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দীন বলেন, ‘প্রেসক্রিপশন লেখার ক্ষেত্রে ডাক্তারদের আরো সচেতন হতে হবে। জনভোগান্তির কথা মাথায় রাখতে হবে। অ্যাসোসিয়েশনের আগামী মিটিংয়ে আমি ঢাকাসহ সারা দেশের বিএমএ নেতাদের জানাব বিষয়টি। আশা করছি এর থেকে পরিত্রাণ সম্ভব।’

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অর্থোপেডিক সার্জারি বিভাগের এক চিকিৎসক বলেন, এভাবে লেখা চিকিৎসকদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। নিজের লেখা প্রেসক্রিপশন অনেক চিকিৎসক পরে দেখলে নিজেই বুঝতে পারেন না যে এটা তারই লেখা।

গত ২ জানুয়ারি চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্র সম্পর্কে হাইকোর্টে রিট করেন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে (এইচআরপিবি) আইনজীবী মনজিল মোরসেদ।

এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ৯ জানুয়ারি স্পষ্ট অক্ষরে ‘পড়ার উপযোগী করে’ চিকিৎসকদের প্রেসক্রিপশন (ব্যবস্থাপত্র) লেখার নির্দেশনা দিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে ৩০ দিনের মধ্যে সার্কুলার জারির নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে ব্যবস্থাপত্রে ওষুধের জেনেরিক নাম লিখতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না- তা জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয়।

বিচারপতি নাঈমা হায়দার ও বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমানের বেঞ্চ রুলসহ এ আদেশ দেন। স্বাস্থ্যসচিব, বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিলের রেজিস্ট্রার, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সেক্রেটারিসহ বিবাদীদের চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়।

এ বিষয়ে রিটকারীর আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশনা মানতে চিকিৎসকরা বাধ্য। আর যদি তা না মেনে কোনো চিকিৎসক হিজিবিজি করে প্রেসক্রিপশন লেখেন, তাহলে বিএমডিসি তাঁদের সনদ বাতিল করার ক্ষমতা রাখে।

মনজিল মোরসেদ আরো বলেন, চিকিৎসকদের মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে। জনসাধারণের ভোগান্তির কথা মাথায় রাখতে হবে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে নিয়মিত ফলোআপ করতে হবে; যাতে জনভোগান্তির কথা মাথায় রেখে চিকিৎসকরা প্রেসক্রিপশন লেখেন।