গ্রেনেড হামলার ১৩ বছর

‘আমার চোখ গেছে, নেত্রী তো বেঁচে আছে’

Looks like you've blocked notifications!

ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার ১৩ বছর পরও শরীরে গ্রেনেডের স্প্লিন্টার বয়ে বেড়াচ্ছেন মাদারীপুরের পাঁচ আওয়ামী লীগকর্মী। দীর্ঘদিন ধরে শরীরের বিভিন্ন স্থানে স্প্লিন্টার থাকার কারণে ক্রমেই অকেজো হয়ে পড়ছে তাঁদের শরীরের একেকটি অংশ। ধীরে ধীরে পঙ্গুত্বের দিকে যাচ্ছেন তাঁরা।

তবে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার এক যুগ পেরিয়ে গেলেও অপরাধীদের বিচার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন হামলায় আহতরা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী শান্তি সমাবেশে নারকীয় গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটে। সে সময় সমাবেশে বক্তব্য দিচ্ছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

মাদারীপুর থেকে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সেই সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন এই পাঁচজনও। হামলায় তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ হারিয়েছেন দৃষ্টিশক্তি। সেদিন গ্রেনেডের আঘাতে প্রাণ হারান রাজৈর উপজেলার হোসেনপুর ইউনিয়নের চানপট্টি গ্রামে যুবলীগ নেতা লিটন মুন্সীসহ চারজন।

আহত হন জেলা সদরের ছিলারচর ইউনিয়নের পশ্চিম রঘুরামপুর গ্রামের রামকৃষ্ণ মণ্ডল, কালকিনি উপজেলার চড় ঝাইতলা গ্রামের দিনমজুর অহেদ আলী সরদারের ছেলে ছাইদুল সরদার, একই উপজেলার কবির হোসেন ও হালান হাওলাদার, দেলওয়ার হোসেন।

গ্রেনেড হামলায় নিহত কালকিনি উপজেলার কয়ারিয়া ইউনিয়নের রামারপোল গ্রামের শ্রমিক লীগ নেতা নাসির উদ্দিন, একই উপজেলার মোস্তাক আহম্মেদ ওরফে কালা সেন্টু ও রাজৈর উপজেলার কদমবাড়ী ইউনিয়নের মহিষমারি গ্রামে সুফিয়া বেগমের পরিবারেও স্মৃতির সাক্ষী শুধুই আহাজারি। আর যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

আহতদের মধ্যে রামকৃষ্ণ মণ্ডল সেদিন চোখ হারিয়েছেন তাঁর ডান চোখ। এখন চলছেন সহধর্মিণীর রোজগারের ওপর। তাঁর স্ত্রী গোবরের জ্বালানি বানিয়ে বিক্রি করেন। তা দিয়েই কোনোমতে ছয়জনের সংসার চালান। চোখ হারিয়েও রামকৃষ্ণ পাননি সামান্য স্বীকৃতিটুকুও। রামকৃষ্ণের চাওয়া, সুচিকিৎসার নিশ্চয়তা, স্বাভাবিক জীবনযাপন। সরকারি সহায়তার দাবি জানিয়েছেন তিনি।

এদিকে, একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে আজো কেঁদে বুক ভাসান লিটন মুন্সীর মা আছিয়া বেগম ও বাবা আইউব আলী মুন্সি। তাঁরা এই নারকীয় হামলার দ্রুত বিচার দাবি করেছেন।

উঠতি বয়সী তরুণ ছাইদুল সরদার। সেদিন আওয়ামী লীগের জনসভায় যোগ দিতে ঢাকায় গিয়েছিলেন তিনিও। গ্রেনেডের আঘাতে এই তরুণ হারিয়েছেন এক চোখের দৃষ্টিশক্তি। এরপর চিকিৎসা চালাতে গিয়ে ফুরিয়েছেন শেষ সম্বলটুকুও। আহত হওয়ার পর তাঁকে পুনর্বাসনের কথা বলা হয়েছিল দলের পক্ষ থেকে। কিন্তু তিনি কোনো সহযোগিতা পাননি। এমনকি তাঁর কোনো খোঁজও নেয়নি কেউ।

ছাইদুল বলেন, ‘এখনো সেই ভয়াল স্মৃতি মনে পড়লে দুই চোখে ঘুম আসে না। কারণ, ঘুমালে দুই চোখে ভেসে আসে সেই ২১ আগস্টের ভয়াল চিত্র। তখন আর ঠিক থাকতে পারি না। ভয়ে শরীরটা শক্ত হয়ে যায়। চিৎকার করে উঠি। আর বলতে থাকি কে আছো, আমাকে বাঁচাও, আমাকে বাঁচাও।’

ছাইদুলদের সংসারে তিন ভাই ও এক বোন। সবাই যার যার মতে চলছে। ছাইদুল সবার ছোট। ২০ বছর আগে হারিয়েছেন মা খোদেজা বেগমকে। বাবা অন্যের জমিতে কাজ করে সংসার চালান।

ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার শিকার হয়ে হারান বাঁ চোখের দৃষ্টিশক্তি। ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় তাঁর শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। এখনো তাঁর শরীরে বোমার আঘাতের চিহ্ন। কিছুদিন বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়েছেন। এরপর অর্থের অভাবে আর চিকিৎসা করানো সম্ভব হয়নি। এখন এভাবেই কেটে যাচ্ছে তাঁর দিন।

ছাইদুল আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমাকে পুনর্বাসন করার কথা ছিল, কিন্তু পাইনি। অর্থের অভাবে উন্নত চিকিৎসা করাতে পারিনি। কেউ কোনো সাহায্যও করেনি।’

মাদারীপুরের দেলওয়ার হোসেন ঢাকায় বাস চালাতেন। আওয়ামী লীগের মিরপুর ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি।

ভয়াল ২১ আগস্টের স্মৃতিচারণ করে দেলওয়ার বলেন, ‘বিস্ফোরণের পর আমার মনে হলো, চোখ দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। চোখে হাত দিয়ে দেখি ঝরঝর করে রক্ত ঝরছে। পরিচিত এক বাসশ্রমিক আমাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যান। ডাক্তাররা আমাকে দেখে জানান, চোখের মণি গলে গেছে গ্রেনেডের আঘাতে। ২৪ দিন চক্ষু হাসপাতালে ছিলাম। বাঁ চোখে আর দেখতে পাই না। আমি খুব গরিব। সংসার চালাতে পারি না। সান্ত্বনা এই যে আমার চোখ গেছে, কিন্তু নেত্রী তো বেঁচে আছে।’

এ ছাড়া গ্রেনেড হামলার শিকার কালকিনি উপজেলার কবির হোসেন ও একই উপজেলার হালান হাওলাদার। উন্নত চিকিৎসার অভাবে ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছেন আহতরা। তাঁরা সামান্য কিছু সাহায্য পেলেও তা জীবনমান উন্নয়নে কোনো কাজে আসেনি।

এ ব্যাপারে কালকিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি তাহমিনা সিদ্দিকী বলেন, ‘সরকারি তহবিল থেকে আহতদের সাহায্য করা হয়েছে। সামনে আরো করা হবে।’

নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান জানান, গ্রেনেড হামলার ঘটনায় নিহত ও আহত পরিবারকে বিভিন্ন সময়ে আর্থিক সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে। অচিরেই এ ঘটনায় বিচারকাজ শেষ হবে।

মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক ওয়াহিদুল ইসলাম জানান, গ্রেনেড হামলায় আহত ও নিহতদের সাহায্যে তিনি পদক্ষেপ নেবেন।